Saturday, November 01, 2025

নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে…

মানুষের স্মৃতি খুব অদ্ভুত। অনেক স্মৃতি আছে যেগুলো মনে না থাকলে ক্ষতি নেই, অনেক স্মৃতি আদতে স্মৃতিই নয়; অন্যের মুখে শুনে মাথায় ভ্রম তৈরি করে, স্মৃতির বেশ ধরে থাকে। এই যেমন, আম্মুর শৈশবের বন্ধু আরতী; যাকে আম্মু প্রায়ই স্বপ্নে দেখত, যে অজানা জ্বরে ভুগে মারা গিয়েছিল খুব ছোট্টবেলায়; তাকে আমার দেখার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু আমার মাথার কোনো এক কোণে আরতীর একটা সাদা-কালো প্রায় ঝলসানো ছবি রয়ে গেছে। সেই ছবি যে কাল্পনিক তাতে কোনোই সন্দেহ নেই, কিন্তু আমি চাইলেই ছবিটা স্পষ্ট দেখতে পাই। আম্মু তার কথা খুব বলত, শৈশবে প্রথম বন্ধু হারানোর ধাক্কা সে পরিণত বয়সেও অনুভব করত একইভাবে। সম্ভবত তার বোধ সৃষ্টির পর “মৃত্যু”কে অনুভব করা সেটাই প্রথম, সেই প্রগাঢ় অনুভূতি তাকে ঘিরে রেখেছিল জীবনের শেষ পর্যন্ত।

এই যে লিখলাম, শেষ পর্যন্ত; কী সহজে! মানুষের শেষ কীসে হয়, কখন হয়? শরীরের আয়ু ফুরালে? শরীর আর মনের আয়ু কি আলাদা? মানুষের বেঁচে থাকা কি তার নিজস্ব যাপিত জীবনে—নাকি অন্যদের গভীরতম স্মরণে, উদযাপনে, স্মৃতিতে? আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগে অজানা জ্বরে হুট করে হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট বালিকা আরতী কি ভীষণভাবে বেঁচে ছিল তার বন্ধুর স্মৃতিতে; এই এতগুলো বছর পরেও! এমনকি আমার, মানে এক প্রজন্ম পরের কোনো একজনের স্মৃতিতে সাদাকালো ছবিতে অস্পষ্ট যে বালিকা বেঁচে থাকে, সে কি আরতী নয়—সে স্মৃতি যতই বিভ্রম হোক?

শেষ কোথায়? শেষ কীসে? আজ তিন বছর হলো, আম্মু চোখ তুলে আমাদের দেখে না, কথা বলে না, কিন্তু তাই বলে কি কিছু ফুরালো? একটা জমাট শূন্যস্থানের ওপারে, যেই শূন্যস্থান ভেদ করে আমাদের দৃষ্টি, কথা, স্পর্শ পৌঁছাতে পারে না; সেখানটায় তার কী প্রবল উপস্থিতি—নাহলে কেন একটা দিনও তাকে ছাড়া কাটে না এখনও?

মৃত্যু নিয়ে ধর্মীয়, অধর্মীয়, বস্তুগত, বৈজ্ঞানিক, অবৈজ্ঞানিক যত ব্যাখ্যাই শুনি, মানুষের চলে যাওয়ার পরেও প্রবলভাবে রয়ে যাওয়ার এই মহাজাগতিক অনুভূতিকে ধরতে পারার মতো কোনো ব্যাখ্যা পাই না। সত্যি বলতে এসব ব্যাখ্যা শুনতে ইচ্ছেও করে না। আম্মুর নম্বরে ডায়াল করলে আম্মুর আদরমাখা গলাটা আর শুনিনা, চাইলেই আম্মুর মুখোমুখি বসে চা খেতে পারি না, বহু আগে হারিয়ে ফেলা সলিল চৌধুরীর গানটা ইউটিউবে হঠাৎ পেয়ে গেলে কাকে শোনাব বুঝে উঠতে পারি না… এই কষ্টগুলি ভোগায়, অনেক অনেক ভোগায়। কষ্টের তীব্রতা সীমা ছাড়ায় যখন নিজের মেয়েটাকে দেখি, যাকে আম্মু কখনো ছুঁয়ে দেখতে পারে নি। কিন্তু তার পরেও আম্মু নেই এমনটা তো মনে হয় না, এক মুহূর্তের জন্যেও না!

বিপুল বিস্তীর্ণ মহাজগতের সুবিশাল সময়ের স্কেলে যেই তুচ্ছ কটা মুহূর্ত আমরা একেকজন মানুষ স্ফুলিঙ্গের মত বেঁচে থাকি—আমাদের স্মৃতি, কল্পনা, অনুভূতির সীমা তো এতটাও ক্ষুদ্র নয়। স্পর্শের সীমার বাইরে চলে গেলেও সেই গাঢ় অনুভূতিতে তো রয়ে যায় একেকজন মানুষ, তার হাসি, তার স্মৃতি।

আম্মু নিজে বুড়ো হবার ব্যাপারটা একেবারেই পছন্দ করত না। আর কী অদ্ভুতভাবে তার বয়সটা এক জায়গায় থমকে গেল! আমরা বুড়ো হয়ে যাব হয়ত একদিন, কিন্তু আকাশের ওপারে যেই আকাশ, সেখানে থাকা আম্মুর কিশোরী হাসিটা একইরকম রয়ে যাবে—যতদিন আমরা থাকি। যতদিন কারো স্মৃতি, বা বিভ্রমে সেই হাসিটা বেঁচে থাকে।


"নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে,
হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে, হৃদয়ে রয়েছ গোপনে..."



No comments:

Post a Comment