Tuesday, October 31, 2023

হাসনাহেনার ঝাড় (পর্ব: শিউলী ফুলের ঘ্রাণ)

শরৎ দিনের সকাল বেলা,
শিউলি ফুল ওই করছে খেলা।
উঠোন ছেয়ে লুটোয় হেসে,
বোঁটায় হলুদ মোহন বেশে।
ছোট্ট মেয়ে মালা গাঁথে,
ফুল নিয়ে ওই কলার পাতে।
শরৎ হাসে সোনার হাসি,
রাখাল ছেলে বাজায় বাঁশি।

এই ছড়া কার লেখা জানা নেই। তবে ছড়াটা এবং তার সাথের অলঙ্করণ এখনো স্পষ্ট মাথায় গেঁথে আছে। অতি ব্যবহারে আমাদের ছোটকালেই বইটার আয়ু ফুরিয়েছে, পরে বহু খুঁজেও আর পাইনি। ছবিটা খুব সম্ভবত বিমল দাসের আঁকা ছিল। তবে অলঙ্করণ চাইলেও ভোলা সম্ভব হত না, কারণ বইপত্রে কোনো সুন্দর ছবি দেখলেই আম্মু তার একটা খাতায় দেখে দেখে সেই ছবি কপি করে রাখত। পরে কোনো টি-কোজি, টেবিলক্লথে, বা কুশনের কভারে শোভা পেত এম্ব্রয়ডারি করা সেই ছবি। লালপেড়ে সবুজ শাড়ি পরা বালিকার শিউলি মালা গাঁথার সেই ছবি এখনো বাসার পুরনো একটা টেবিলক্লথে যত্নে আছে, ৩৪/৩৫ বছরে সুতার রং কিছুটা ফিকে হয়েছে- এই যা। 

তিন দশকেরও বেশি আগে আম্মুর করা এম্ব্রয়ডারি, সেই শিউলি মালা



ভাগ্যিস, তখন কপিরাইট আর প্লেজারিজম নিয়ে বাসাবাড়িতে কেউ মাথা ঘামাত না!

শিউলি ফুলের সাথে আম্মুর গায়ের ঘ্রাণ আমার স্মৃতিতে কেমন এলোমেলো হয়ে মিশে থাকে। সবচেয়ে পুরনো স্মৃতিরও আগে, একেবারে ছোট্টবেলার যে কটি খাপছাড়া ছবি মাথার কোনো কোণে বিচিত্রভাবে থেকে গেছে, তার মধ্যে একটা হলো এই শিউলি ফুল কুড়ানোর ছবি। তখন আব্বুর পোস্টিং সিলেটে, আমাদের সরকারি বাসার ঠিক সামনেই বোধ হয় ছিল একটা মস্ত বড় (অন্তত তখন তাই মনে হতো) শিউলি গাছ। খুব ভোরে হিম হিম বাতাসে আম্মু আর আমরা দুই বোন শিউলি কুড়িয়ে নিয়ে এসেছি, কিছুক্ষণ পর ড্রইংরুমে একটা ছোট ঝুড়িতে রাখা সেই ফুলের গায়ে বিন্দু বিন্দু শিশির; এই অকারণ ছবিটা এত বছর পরেও একেবারে স্পষ্ট যেন দেখতে পাই!

মানুষের স্মৃতি বড়ই অদ্ভুত। খুব প্রয়োজনীয় অনেক কিছু যেমন ভুলে গেছি, আবার খুব অদরকারি সব ঘটনা এমনভাবে মনে পড়ে যেন এই সেদিনের কথা। ময়মনসিংহে আমরা যেই বাসায় প্রায় বছর দশেক ছিলাম, সেই বাসার রুমগুলো কেমন ছিল আমার কেন যেন ঠিকমত মনে পড়ে না। অথচ, পাশেই রেস্টহাউজের টেরেসে ফোটা অলকানন্দা ফুলের রং আর টেক্সচার কেমন ছিল তা এতকাল পরেও এত স্পষ্ট মনে পড়ে। 

ময়মনসিংহের বাসায় অনেক ফুলের গাছ ছিল, কিন্তু কোনো শিউলি গাছ ছিল না। এ নিয়ে আমার খুব দুঃখ ছিল, সিলেটের বাসার সেই শিউলি ফুলের কথা ভেবে প্রায়ই মন খারাপ হতো। একবার ক্লাস টু তে থাকতে এক বন্ধু এনে দিল এক মুঠ শিউলি ফুলের বীজ; সেই গাছ লাগানো নিয়ে আমার সে কি উত্তেজনা! প্রথম যেদিন আম্মু সকালে ডেকে তুলে দেখালো আমার নিজের গাছে ফোটা প্রথম শিউলি ফুল, সে দিনের মতো আনন্দ আমি এই জীবনে খুব বেশি আর পাইনি। 

ফুল গাছ নিয়ে আম্মু এবং আমাদের দুই বোনের উত্তেজনা ছিল দেখার মতো। সরকারি বাসায় থাকার কারণে বাসার সামনে বড়সড় একটা বাগান ছিল আমাদের। বাসা থেকে কয়েক গজ দূরে বিটিভির অফিসের সামনের বাগানটা ছিল আরো একটু বড়। প্রতি শীতে যখন মৌসুমী ফুলের গাছ লাগানোর তোড়জোড় শুরু হতো, আমরা তিনজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম; কী কী রঙের জিনিয়া ফুল ফুটবে এবার? ডালিয়া ফুলের গাছ লাগানো হলো কয় রঙের? অফিসের মালী গণি কাকাকে জিজ্ঞেস করলে কুচকুচে কালো মানুষটা তার ঝকঝকে দাঁত বের করে হেসে বলতেন, "ফুল ফুটুক, নিজেই দেখবা!"

আম্মুর সবচেয়ে প্রিয় ফুল ছিল বেলী। গাছভর্তি ধবধবে সাদা বেলীফুলের উপর যখন আষাঢ়ের বৃষ্টি ঝিরঝির করে পড়ত, আম্মু জানালা দিয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখত সেই দৃশ্য। সকল সুগন্ধি সাদা ফুল ছিল আম্মুর প্রিয়। তবে সাদা কখনও তার প্রিয় রং ছিল না; বরং প্রিয় ছিল উজ্জ্বল মেরুন, ফিরোজা, গেরুয়ার শেড। ম্যাড়মেড়ে রঙের শাড়ি কোনোকালেই শখ করে তাকে পরতে দেখিনি। বড় হয়ে আমাদের যখন সাদা বা ছাই রঙের শাড়ির প্রতি ভালবাসা জন্মালো, তা দেখেও তার অনুযোগের শেষ ছিল না। 

এক সকালের কথা খুব মনে পড়ে। ঝমঝমে বর্ষার দিন, আম্মুর ডাকাডাকিতে কাকভোরে ঘুম ভাঙল; দেখি উত্তেজনায় আম্মু কিশোরী মেয়েদের মতো ঝলমল করছে, "তাড়াতাড়ি বাইরে এসে দেখো!"

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি হতভম্ব, বাসার সামনে খোলা জায়গায় থই থই পানি, তার মধ্যে যেদিকে চোখ যায় শত শত সোনাব্যাঙ, তারস্বরে ডেকে চলেছে। তাদের গায়ের সবুজ সোনালী রঙে পুরো মাঠ ঝলমল করছে। 

স্মৃতিশক্তি কম বলেই বোধ হয়, ছোটবেলার বেশির ভাগ ঘটনার ক্ষেত্রেই আমার রং আর ঘ্রাণ ছাড়া তেমন কিছুই মনে পড়ে না। ছোটবেলার স্মৃতিতে আম্মুকে আমার মনে হয় যেন একটা রংভর্তি প্যালেট, যেখানে কোনো শিশু ভাবনাহীনভাবে হাজার রঙের টিউব ঢেলে দিয়েছে। 

সেই আম্মুকে আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে শেষ সাদা কাপড়ে রেখে এসেছি। আম্মুকে সাদা রঙে কোনোদিন মানায়নি, সেদিনও না। 
২০১৩ সালে করা কুইক স্কেচ... যখন চাইলেই সামনে বসে আম্মুকে আঁকা যেত


Friday, April 07, 2023

হাসনাহেনার ঝাড় (পর্ব: প্রথম ইশকুল)

আমার জীবনে শেখা প্রথম কঠিন বানান হলো ENGINEER। 

বাপ রে, কত্তগুলো অক্ষর! বানানের সাথে উচ্চারণের মিল থাকলেও না হয় মনে রাখা যেত! তাও না। ইঞ্জিনিয়ার যদি হয় উচ্চারণ, তবে বানানটা হবার কথা INJINIAR। এমন আজব কেনো বানানের নিয়ম তা আমার ছোট মাথায় ঢুকতই না। 

EN-GI-NEER, আম্মু এভাবে ভেঙে ভেঙে শেখাত। বড় শব্দকে তিন টুকরা করে, ভাত খাওয়ানোর সময় বড় লোকমাকে ছোট ছোট করে পায়রার ডিম, মুরগির ডিম বানিয়ে যেভাবে খাওয়াত, অনেকটা সেভাবে। তো ঐ বয়সে এই শব্দ শেখার দরকার কেনো পড়ল? ওই যে- স্কুলে ইংরেজি ক্লাসে যখন নিজের সম্পর্কে লিখতে হতো, ‘My father is an engineer, my mother is a housewife…’। তখন মনে হতো, আব্বু ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে সহজ কিছু কেনো হলো না- এই যেমন Farmer, Doctor, এরকম কিছু। এক বন্ধুর বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী, তাকে ‘My father is a businessman’ লিখতে দেখে আমার রীতিমত মায়াই লেগেছিল! 

এইটুকু পড়ে মনে হতে পারে, কঠিন কঠিন শব্দে অনেক ভীতি ছিল আমার। কথাটা আংশিক সত্যি। ইংরেজি গল্পের বই আম্মু টুকটাক পড়ে শোনাতো বটে, কিন্তু কঠিন শব্দ বানান বুঝে পড়া তখনো শিখিনি। বাংলা বরং অনেক সোজা, গল্প আর ছড়ায় কঠিন কঠিন শব্দগুলোও কী সুন্দর ঠিক ঠিক এঁটে যায়! আম্মু আমাদের দুই বোনকে কোলের উপর বসিয়ে যখন ‘পুরাতন ভৃত্য’ বা ‘দুই বিঘা জমি’ আবৃত্তি করে শোনাতো, মোটেও কঠিন মনে হতো না লাইনগুলো। তবে এগুলো বড় দুঃখের কবিতা। আমার বেশি প্রিয় ছিল ‘খাঁদু দাদু’ আর ‘লিচু চোর’। 

দুঃখের কবিতাগুলো আমার কাছে মনে হতো যেন ঠিকমত শেষ হয়নি, যেন আরো কিছু ঘটার কথা ছিল। ‘পুরাতন ভৃত্য’ পড়ে একেবারে মুষড়ে গেছিলাম, কেষ্টা যে একেবারে মরেই গেল! মরে যাবার পরে যে আর কিছু ঘটবার থাকে না তা বোঝার বয়স তখনই হয়েছিল। 

তবে আম্মু বোধ হয় তার বছর পাঁচেকের কন্যার মন খারাপটা দেখতে চায়নি। তাই আমাদের পড়ে শোনানোর সময় কবিতার শেষটুকু প্রায়ই বদলে যেত। ‘দুই বিঘা জমি’ তে জমিদারবাবু উপেনের জমি কীভাবে ‘ডিক্রি’ জারি করে হাতিয়ে নিল তা আমি মেনেই নিতে পারতাম না। বলতে গেলে বাধ্য হয়েই, আম্মু কবিতার শেষটা সামান্য পাল্টে দিলো। তাই আমার ছোটবেলার স্মৃতিতে ‘দুই বিঘা জমি’তে পুরোদস্তুর হ্যাপি এন্ডিং, কবিতার শেষ লাইন আর উপেনের মুখে রইলো না। বরং শেষ দৃশ্যে বাবু নিজেই তার ভুল বুঝতে পেরে উপেনের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছে,

‘তুমি মহারাজ, সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।’

পরপারে বসে রবি ঠাকুর নিশ্চয়ই আম্মুর এই নিদারুণ অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন!

রবীন্দ্র-নজরুলের সাথে আম্মুর এই সখ্যতার কারণে আমাদের ভাণ্ডারে শব্দের কমতি ছিল না। একবার থ্রি-ফোরে থাকতে একটা কঠিন বাংলা শব্দ শেখা হলো- ‘পৃষ্ঠ-পো-ষ-ক-তা’, কোন বই থেকে পড়েছিলাম এখন আর মনে নেই। তবে বেশ পছন্দ হলো শব্দটা, মুর্ধন্য-ষ, ঠ, ক, ত মিলিয়ে বেশ একটা এলাহি অবস্থা, লিখতে গেলেই নিজের মধ্যে বেশ জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব চলে আসে। প্রথম সুযোগেই এই শব্দ চালিয়ে দিয়েছিলাম বাংলা পরীক্ষার খাতায়, বাংলা শিক্ষকের অবাক করা চেহারা দেখে বেশ একটা গর্বও হয়েছিল মনে পড়ে। সেই গর্ব ভাঙতে বেশিদিন লাগে নি, তবে সে কথায় পরে আসি।

সত্যি বলতে, তখন পর্যন্ত স্কুল আমার বেশ ভালই লাগত। আসলে স্কুল যে একটা টর্চার সেল, সেটা বুঝেছি বেশ কবছর স্কুলে যাবার পর। এটার বড় কারণ খুব সম্ভবত প্রথম স্কুলের অভিজ্ঞতা। প্রথম স্কুল বলতে আমাদের কাছে যা ছিল তা হলো সন্ধ্যাবেলায় আম্মুর কাছে পড়তে বসা। তবে সে স্কুলেও কায়দা কানুনের অভাব ছিল না। সিরামিক আর মেলামাইনের ভরভরন্ত কালের আগে মধ্যবিত্ত বাসাবাড়িতে খাওয়া হতো স্টিলের প্লেটে। সেই স্টিলের প্লেট আর ভাতের চামচ হতো আমাদের স্কুলের ঘণ্টা। আমরা দুই বোন গম্ভীর মুখে ব্যাগে বইপত্র নিয়ে রেডি হয়ে পাশের ঘরে অপেক্ষা করতাম, আর ঘণ্টা পড়লেই আমাদের ছোট্ট পড়ার টেবিলে এসে বসতাম। আম্মু হতো ক্লাস টিচার, আর টিফিনে থাকত বাসায় বানানো হালকা পাতলা নাশতা। এই স্কুলের বইপত্র ছিলো বিচিত্র। কলকাতায় ছাপা বিমল দাসের আঁকা ছবির সাথে ছড়া আর গল্পের বই থাকতই, আর থাকত এপার-ওপার বাংলা মিলে নানা জাতের বাংলা বর্ণ আর শব্দ শেখার বই, তবে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় ছিল টোনাটুনির ক্যাসেট। মজিবুর রহমান দিলু, যাকে আমরা সংশপ্তকের ‘মালু’ নামেই চিনতাম, তার ভরাট গলায় যখন বেজে উঠত ‘এবার ক্যাসেটটা উল্টিয়ে দিয়ে শোনো…’, আমাদের দুই বোনের কাড়াকাড়ি লেগে যেত কে আগে গিয়ে ক্যাসেট ওল্টাবে। 


(চলবে)