Friday, April 07, 2023

হাসনাহেনার ঝাড় (পর্ব: প্রথম ইশকুল)

আমার জীবনে শেখা প্রথম কঠিন বানান হলো ENGINEER। 

বাপ রে, কত্তগুলো অক্ষর! বানানের সাথে উচ্চারণের মিল থাকলেও না হয় মনে রাখা যেত! তাও না। ইঞ্জিনিয়ার যদি হয় উচ্চারণ, তবে বানানটা হবার কথা INJINIAR। এমন আজব কেনো বানানের নিয়ম তা আমার ছোট মাথায় ঢুকতই না। 

EN-GI-NEER, আম্মু এভাবে ভেঙে ভেঙে শেখাত। বড় শব্দকে তিন টুকরা করে, ভাত খাওয়ানোর সময় বড় লোকমাকে ছোট ছোট করে পায়রার ডিম, মুরগির ডিম বানিয়ে যেভাবে খাওয়াত, অনেকটা সেভাবে। তো ঐ বয়সে এই শব্দ শেখার দরকার কেনো পড়ল? ওই যে- স্কুলে ইংরেজি ক্লাসে যখন নিজের সম্পর্কে লিখতে হতো, ‘My father is an engineer, my mother is a housewife…’। তখন মনে হতো, আব্বু ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে সহজ কিছু কেনো হলো না- এই যেমন Farmer, Doctor, এরকম কিছু। এক বন্ধুর বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী, তাকে ‘My father is a businessman’ লিখতে দেখে আমার রীতিমত মায়াই লেগেছিল! 

এইটুকু পড়ে মনে হতে পারে, কঠিন কঠিন শব্দে অনেক ভীতি ছিল আমার। কথাটা আংশিক সত্যি। ইংরেজি গল্পের বই আম্মু টুকটাক পড়ে শোনাতো বটে, কিন্তু কঠিন শব্দ বানান বুঝে পড়া তখনো শিখিনি। বাংলা বরং অনেক সোজা, গল্প আর ছড়ায় কঠিন কঠিন শব্দগুলোও কী সুন্দর ঠিক ঠিক এঁটে যায়! আম্মু আমাদের দুই বোনকে কোলের উপর বসিয়ে যখন ‘পুরাতন ভৃত্য’ বা ‘দুই বিঘা জমি’ আবৃত্তি করে শোনাতো, মোটেও কঠিন মনে হতো না লাইনগুলো। তবে এগুলো বড় দুঃখের কবিতা। আমার বেশি প্রিয় ছিল ‘খাঁদু দাদু’ আর ‘লিচু চোর’। 

দুঃখের কবিতাগুলো আমার কাছে মনে হতো যেন ঠিকমত শেষ হয়নি, যেন আরো কিছু ঘটার কথা ছিল। ‘পুরাতন ভৃত্য’ পড়ে একেবারে মুষড়ে গেছিলাম, কেষ্টা যে একেবারে মরেই গেল! মরে যাবার পরে যে আর কিছু ঘটবার থাকে না তা বোঝার বয়স তখনই হয়েছিল। 

তবে আম্মু বোধ হয় তার বছর পাঁচেকের কন্যার মন খারাপটা দেখতে চায়নি। তাই আমাদের পড়ে শোনানোর সময় কবিতার শেষটুকু প্রায়ই বদলে যেত। ‘দুই বিঘা জমি’ তে জমিদারবাবু উপেনের জমি কীভাবে ‘ডিক্রি’ জারি করে হাতিয়ে নিল তা আমি মেনেই নিতে পারতাম না। বলতে গেলে বাধ্য হয়েই, আম্মু কবিতার শেষটা সামান্য পাল্টে দিলো। তাই আমার ছোটবেলার স্মৃতিতে ‘দুই বিঘা জমি’তে পুরোদস্তুর হ্যাপি এন্ডিং, কবিতার শেষ লাইন আর উপেনের মুখে রইলো না। বরং শেষ দৃশ্যে বাবু নিজেই তার ভুল বুঝতে পেরে উপেনের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছে,

‘তুমি মহারাজ, সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।’

পরপারে বসে রবি ঠাকুর নিশ্চয়ই আম্মুর এই নিদারুণ অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন!

রবীন্দ্র-নজরুলের সাথে আম্মুর এই সখ্যতার কারণে আমাদের ভাণ্ডারে শব্দের কমতি ছিল না। একবার থ্রি-ফোরে থাকতে একটা কঠিন বাংলা শব্দ শেখা হলো- ‘পৃষ্ঠ-পো-ষ-ক-তা’, কোন বই থেকে পড়েছিলাম এখন আর মনে নেই। তবে বেশ পছন্দ হলো শব্দটা, মুর্ধন্য-ষ, ঠ, ক, ত মিলিয়ে বেশ একটা এলাহি অবস্থা, লিখতে গেলেই নিজের মধ্যে বেশ জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব চলে আসে। প্রথম সুযোগেই এই শব্দ চালিয়ে দিয়েছিলাম বাংলা পরীক্ষার খাতায়, বাংলা শিক্ষকের অবাক করা চেহারা দেখে বেশ একটা গর্বও হয়েছিল মনে পড়ে। সেই গর্ব ভাঙতে বেশিদিন লাগে নি, তবে সে কথায় পরে আসি।

সত্যি বলতে, তখন পর্যন্ত স্কুল আমার বেশ ভালই লাগত। আসলে স্কুল যে একটা টর্চার সেল, সেটা বুঝেছি বেশ কবছর স্কুলে যাবার পর। এটার বড় কারণ খুব সম্ভবত প্রথম স্কুলের অভিজ্ঞতা। প্রথম স্কুল বলতে আমাদের কাছে যা ছিল তা হলো সন্ধ্যাবেলায় আম্মুর কাছে পড়তে বসা। তবে সে স্কুলেও কায়দা কানুনের অভাব ছিল না। সিরামিক আর মেলামাইনের ভরভরন্ত কালের আগে মধ্যবিত্ত বাসাবাড়িতে খাওয়া হতো স্টিলের প্লেটে। সেই স্টিলের প্লেট আর ভাতের চামচ হতো আমাদের স্কুলের ঘণ্টা। আমরা দুই বোন গম্ভীর মুখে ব্যাগে বইপত্র নিয়ে রেডি হয়ে পাশের ঘরে অপেক্ষা করতাম, আর ঘণ্টা পড়লেই আমাদের ছোট্ট পড়ার টেবিলে এসে বসতাম। আম্মু হতো ক্লাস টিচার, আর টিফিনে থাকত বাসায় বানানো হালকা পাতলা নাশতা। এই স্কুলের বইপত্র ছিলো বিচিত্র। কলকাতায় ছাপা বিমল দাসের আঁকা ছবির সাথে ছড়া আর গল্পের বই থাকতই, আর থাকত এপার-ওপার বাংলা মিলে নানা জাতের বাংলা বর্ণ আর শব্দ শেখার বই, তবে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় ছিল টোনাটুনির ক্যাসেট। মজিবুর রহমান দিলু, যাকে আমরা সংশপ্তকের ‘মালু’ নামেই চিনতাম, তার ভরাট গলায় যখন বেজে উঠত ‘এবার ক্যাসেটটা উল্টিয়ে দিয়ে শোনো…’, আমাদের দুই বোনের কাড়াকাড়ি লেগে যেত কে আগে গিয়ে ক্যাসেট ওল্টাবে। 


(চলবে)