Saturday, November 01, 2025

নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে…

মানুষের স্মৃতি খুব অদ্ভুত। অনেক স্মৃতি আছে যেগুলো মনে না থাকলে ক্ষতি নেই, অনেক স্মৃতি আদতে স্মৃতিই নয়; অন্যের মুখে শুনে মাথায় ভ্রম তৈরি করে, স্মৃতির বেশ ধরে থাকে। এই যেমন, আম্মুর শৈশবের বন্ধু আরতী; যাকে আম্মু প্রায়ই স্বপ্নে দেখত, যে অজানা জ্বরে ভুগে মারা গিয়েছিল খুব ছোট্টবেলায়; তাকে আমার দেখার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু আমার মাথার কোনো এক কোণে আরতীর একটা সাদা-কালো প্রায় ঝলসানো ছবি রয়ে গেছে। সেই ছবি যে কাল্পনিক তাতে কোনোই সন্দেহ নেই, কিন্তু আমি চাইলেই ছবিটা স্পষ্ট দেখতে পাই। আম্মু তার কথা খুব বলত, শৈশবে প্রথম বন্ধু হারানোর ধাক্কা সে পরিণত বয়সেও অনুভব করত একইভাবে। সম্ভবত তার বোধ সৃষ্টির পর “মৃত্যু”কে অনুভব করা সেটাই প্রথম, সেই প্রগাঢ় অনুভূতি তাকে ঘিরে রেখেছিল জীবনের শেষ পর্যন্ত।

এই যে লিখলাম, শেষ পর্যন্ত; কী সহজে! মানুষের শেষ কীসে হয়, কখন হয়? শরীরের আয়ু ফুরালে? শরীর আর মনের আয়ু কি আলাদা? মানুষের বেঁচে থাকা কি তার নিজস্ব যাপিত জীবনে—নাকি অন্যদের গভীরতম স্মরণে, উদযাপনে, স্মৃতিতে? আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগে অজানা জ্বরে হুট করে হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট বালিকা আরতী কি ভীষণভাবে বেঁচে ছিল তার বন্ধুর স্মৃতিতে; এই এতগুলো বছর পরেও! এমনকি আমার, মানে এক প্রজন্ম পরের কোনো একজনের স্মৃতিতে সাদাকালো ছবিতে অস্পষ্ট যে বালিকা বেঁচে থাকে, সে কি আরতী নয়—সে স্মৃতি যতই বিভ্রম হোক?

শেষ কোথায়? শেষ কীসে? আজ তিন বছর হলো, আম্মু চোখ তুলে আমাদের দেখে না, কথা বলে না, কিন্তু তাই বলে কি কিছু ফুরালো? একটা জমাট শূন্যস্থানের ওপারে, যেই শূন্যস্থান ভেদ করে আমাদের দৃষ্টি, কথা, স্পর্শ পৌঁছাতে পারে না; সেখানটায় তার কী প্রবল উপস্থিতি—নাহলে কেন একটা দিনও তাকে ছাড়া কাটে না এখনও?

মৃত্যু নিয়ে ধর্মীয়, অধর্মীয়, বস্তুগত, বৈজ্ঞানিক, অবৈজ্ঞানিক যত ব্যাখ্যাই শুনি, মানুষের চলে যাওয়ার পরেও প্রবলভাবে রয়ে যাওয়ার এই মহাজাগতিক অনুভূতিকে ধরতে পারার মতো কোনো ব্যাখ্যা পাই না। সত্যি বলতে এসব ব্যাখ্যা শুনতে ইচ্ছেও করে না। আম্মুর নম্বরে ডায়াল করলে আম্মুর আদরমাখা গলাটা আর শুনিনা, চাইলেই আম্মুর মুখোমুখি বসে চা খেতে পারি না, বহু আগে হারিয়ে ফেলা সলিল চৌধুরীর গানটা ইউটিউবে হঠাৎ পেয়ে গেলে কাকে শোনাব বুঝে উঠতে পারি না… এই কষ্টগুলি ভোগায়, অনেক অনেক ভোগায়। কষ্টের তীব্রতা সীমা ছাড়ায় যখন নিজের মেয়েটাকে দেখি, যাকে আম্মু কখনো ছুঁয়ে দেখতে পারে নি। কিন্তু তার পরেও আম্মু নেই এমনটা তো মনে হয় না, এক মুহূর্তের জন্যেও না!

বিপুল বিস্তীর্ণ মহাজগতের সুবিশাল সময়ের স্কেলে যেই তুচ্ছ কটা মুহূর্ত আমরা একেকজন মানুষ স্ফুলিঙ্গের মত বেঁচে থাকি—আমাদের স্মৃতি, কল্পনা, অনুভূতির সীমা তো এতটাও ক্ষুদ্র নয়। স্পর্শের সীমার বাইরে চলে গেলেও সেই গাঢ় অনুভূতিতে তো রয়ে যায় একেকজন মানুষ, তার হাসি, তার স্মৃতি।

আম্মু নিজে বুড়ো হবার ব্যাপারটা একেবারেই পছন্দ করত না। আর কী অদ্ভুতভাবে তার বয়সটা এক জায়গায় থমকে গেল! আমরা বুড়ো হয়ে যাব হয়ত একদিন, কিন্তু আকাশের ওপারে যেই আকাশ, সেখানে থাকা আম্মুর কিশোরী হাসিটা একইরকম রয়ে যাবে—যতদিন আমরা থাকি। যতদিন কারো স্মৃতি, বা বিভ্রমে সেই হাসিটা বেঁচে থাকে।


"নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে,
হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে, হৃদয়ে রয়েছ গোপনে..."



Friday, November 22, 2024

হাসনাহেনার ঝাড়: পর্ব- রং, সুর আর ঘ্রাণ

রঙের সাথে ঘ্রাণ আর স্বাদের এসোসিয়েশন হয় কী করে এটার উত্তর অনেকদিন খুঁজেছি। বেগুনি রঙের সাথে তেতো একটা স্বাদ কেন পাই, কেনোই বা হলুদ রংটার সাথে একটা ঘাস ঘাস ঘ্রাণ মিশে থাকে এর কারণ বুঝিনি অনেকদিন। তারপর এক কটকটে রোদের দিন ঢাকার রাস্তার বিচ্ছিরি জ্যাম আর বাস কন্ডাক্টরের খিস্তি ছাপিয়ে চোখ কেড়ে নিলো একগোছা ঝলমলে হলুদ অলকানন্দা ফুল। একটা মলিন বাড়ির ততোধিক মলিন বারান্দায় একদম বেমানান হয়ে ফুটে আছে। দেখে মনে হচ্ছে খুব সুবেশী একদল মানুষ ভীষণ অস্বস্তিতে ফার্মগেট টু যাত্রাবাড়ী বাসের চলতা উঠে যাওয়া চিটচিটে সীটে বসে উসখুস করছে। 

তো সেই অলকানন্দা ফুল একধাক্কায় নিয়ে গেলো ছোটবেলায়, ময়মনসিংহের যে গেস্ট হাউজে আমরা থাকতাম তার দোতলার টেরেসে ছিল এই অলোকানন্দার বিশাল ঝাড়। এত সুন্দর ফুল কিন্তু তেমন সুঘ্রাণ নেই, কেমন ঘাস ঘাস ঘ্রাণ, খুব অবাক লাগত। এই ফুলের পাপড়ি গুটিয়ে খুব জোরে হাতের তেলোয় মারলে পটকা ফোটার মত শব্দ হয়, আম্মু শিখিয়েছিল এই খেলা। সরকারি অফিসের চৌহদ্দিতে, অতি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বড় হবার কারণে পটকা, তারাবাতির মত দোষণীয় দ্রব্য কোনোকালেই আমাদের নাগালে ছিল না, তাই অলকানন্দার এই পটকা ফোটার শব্দেই আমাদের খুব আনন্দ হতো। এই ফুলের পাশেই ছিল নীলচে বেগুনি রঙের, ঘণ্টা আকৃতির অতি সুদৃশ্য আরেক জাতের ফুলের ঝাড়, পরে জেনেছি এর নাম নীল পারুল। আম্মু আগেই সতর্ক করেছিল, এই ফুল নিয়ে খেললে ভালো করে হাত ধুয়ে ফেলতে; কিন্তু সে কি আর মনে থাকে? ফলস্বরূপ, অসাবধানে হাত গেলো মুখে, আর বিচ্ছিরি তেতো স্বাদ মনে হয় যেন নাকে মুখে ছড়িয়ে গেলো। এত সুন্দর ফুলের এই রকম স্বাদ, কী অবাক কান্ড!

ভাগ্যিস এটাই আমাদের একমাত্র খেলা ছিল না।

শিশু বয়সে খুব প্রচলিত যেসব খেলা, যেমন বউছি বা ডাংগুলি খেলার সাথে আমাদের তেমন পরিচয় ছিল না। দলে বলে খেলার সুযোগ শুধু স্কুলের টিফিন পিরিয়ডের অল্প সময়টুকু, বরফপানি বা ওপেন্টি বায়স্কোপের জন্যেও সেটা বড় অল্প সময়। বাসায় ফেরার পর আমরা বড় দুইবোনই পরস্পরের একমাত্র খেলার সঙ্গী, সবচে ছোটটার তখনও জন্ম হয়নি, আরেক বোন তখনও মাটির সাথে কথা বলে। এখন যেই সময়ের কথা বলছি সেটা অবশ্য স্কুলে ভর্তি হবারও আগের। ঐসময় যেহেতু অন্য সংগীসাথি নেই, দুইজন মিলে বিচিত্র সব খেলা উদ্ভাবন করাই ছিল আমাদের কাজ। অবশ্য ভুল বললাম, আমাদের খেলার একজন দুর্দান্ত সঙ্গী ছিল, আম্মু। ফেলনা কাপড় পেঁচিয়ে পুতুল বানানোর আইডিয়া দেয়া থেকে শুরু করে রান্নাবাটী খেলায় মেহমান হয়ে এসে রান্নার প্রশংসা করা, কোনোকিছুতেই তার আগ্রহের কমতি ছিল না।

অবশ্য খেলার চেয়েও বেশি আম্মুর আগ্রহ ছিল ক্রাফটিংয়ে। সেই সুবাদে আমাদের খেলায় দারুণ সব অনুষঙ্গ যোগ হতো। যেমন, রান্নাবাটি খেলা তো সব বাচ্চারাই খেলে, আমাদের ক্ষেত্রে এই খেলা ছিল improvised। আমাদের ছোট ছোট হাঁড়িপাতিলের সাথে ছোট্ট একটা ফ্রিজও ছিল! পুরোনো প্যাকিং বাক্সের শোলা কেটে কুটে আম্মু বানিয়ে দিয়েছিল এই ফ্রিজ, তাতে পাল্লা ছিল, শেলফ পর্যন্ত ছিল। আমরা খেলা শেষে সিরিয়াস মুখে 'left over' গুলো ফ্রিজে তুলে রাখতাম!
আর ছিল আমাদের টিভি। ম্যাচের বা সিগারেটের বাক্সের সামনের দিকে চৌকোনা করে কেটে বানানো হতো স্ক্রিন, ভেতরে হাতে আঁকা ছবি বায়স্কোপের মত সেট করে কাঠি দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখা যেতো।

আম্মুর থেকে ক্র্যাফটিংয়ের শখ আমাদের দুইবোনের মধ্যেই সংক্রমিত হয়েছিল। একবার খুব মাটির জিনিস বানানোর হিড়িক পড়ল আমাদের। অফিস ও আমাদের বাসার বাগান দেখাশোনার জন্য ছিলেন গণি কাকা, কুচকুচে কালো কষ্টিপাথরের মত রং, পেটা শরীর, আর মুখভর্তি হাসি নিয়ে আমাদের নানা আবদার মেটাতেন তিনি। আব্বুকে যেগুলো বলার সাহস নেই, সেসব শখ মেটানোর জন্য গণি কাকা, মোতালেব কাকা, আইনদ্দি কাকা ছিলেন এক পায়ে খাড়া। আমরা মাটির জিনিস বানালে ভেঙে ভেঙে পড়ে, তাই দেখে গণি কাকা অফিসের পুকুরের নিচ থেকে এনে দিলেন আঠালো এঁটেল মাটি। সেই মাটি দিয়ে বানানো হলো নৌকা, ঘর, টেপা পুতুল। বানানো শেষে একেকটা শিল্পকর্ম আম্মুকে দেখানো হতো, সেখানে সবসময়ই কিছু ফিডব্যাক পাওয়া যেতো। আম্মু কখনোই অকারণ প্রশংসায় ভাসিয়ে দিত না, কাজেই তার মতামত আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আস্তে আস্তে শিখলাম, মাটির সাথে খড় কুচি মিশিয়ে দিলে টেকসই হয় বেশি। 

মাটির জিনিস বানানোর থেকে সহজ ছিল কাগজের ক্র্যাফটিং; কাগজের ফুল, কিংবা ঈদের আগে বা নববর্ষের সময় আর্ট পেপার কেটে বানানো কার্ড। সরকারি বাসার বিশাল ড্রয়িংরুম ছিল আমাদের কাজের ওয়ার্কশপ, ব্যাকগ্রাউন্ডে হেমন্ত উদাত্ত কণ্ঠে গেয়ে চলতেন, "ধিতাং ধিতাং বোলে, কে মাদলে তান তোলে, কার আনন্দ উচ্ছ্বলে আকাশ ভরে জোছনায়..."। 

অঞ্জন তখনও তার পুরোনো গিটার বাজিয়ে আমাদের আকুল করেন নি; কবীর সুমন তখনো চ্যাটার্জি, গানওয়ালা নিয়ে হাজির হন নি আমাদের ড্রয়িংরুমে। কাজেই আমাদের শৈশব তখন পর্যন্ত হেমন্তের কণ্ঠে আর সলিল চৌধুরীর সুরেই বলতে গেলে বাঁধা ছিল, আর মাঝে মাঝে ছিল শ্যামল মিত্র, সাগর সেন, সুচিত্রা মিত্রদের যাওয়া আসা। 

বলাই বাহুল্য, শৈশবের এসকল সুর আম্মুর থেকেই পাওয়া।

রঙের সাথে ঘ্রাণের এসোসিয়েশনের কথায় ফিরে যাই। একবার খুব আয়োজন করে বাসা রং করা হলো, চুনকামের ঘ্রাণে বাতাস ভারি। সেই থেকে হলদে সাদা রংটা কিভাবে যেনো এই চুনকামের ঘ্রাণের মধ্যে আটকে গেলো। এখনও কোথাও এই রং দেখলেই নাকে এই ঘ্রাণ ধাক্কা দেয়। তবে ধবধবে সাদা রংটা সবসময় বেলি আর গন্ধরাজের জন্য বাঁধা, সাদা মানেই বর্ষাকাল, গন্ধরাজ বা বেলির পাঁপড়ির ওপর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। সাদা রঙের সাথে বর্ষার ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণটাই ছিল আজীবনের এসোসিয়েশন।

তবে সেটা দুবছর আগে সব ওলটপালট হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত।

সাদা ছিল বেলি আর গন্ধরাজের ঘ্রাণ। এখন সাদা রং মানে শুধুই আইসিইউ, হাসপাতাল, আর বিষণ্ন মৃত্যুর ঘ্রাণ।

আমাদের সব সুর, রং, ঘ্রাণ বুকে নিয়ে একটা মানুষ চলে গেছে। আজ তার জন্মদিন।

শুভ জন্মদিন আম্মু!

Tuesday, November 19, 2024

সময় আসুক, একদিন বুঝবা!

ক্লাস সেভেনে রেজাল্ট বেশ খারাপ হয়েছিল, আগের সব বছরের চেয়ে খারাপ। তখন একটা ভয়ানক চল ছিল। এসএসসি আর এইচএসসিতে স্ট্যান্ড করা, মেধাতালিকায় প্রথম দ্বিতীয় হওয়া কয়েকজনকে টিভিতে আনা হতো। চশমা পরা, বয়সের তুলনায় অস্বাভাবিক গম্ভীর সেইসব ছেলেমেয়েরা তাদের সাফল্যের পেছনের পরিশ্রমের গল্প শুনাত; কেউ পড়ালেখা করেছে দিনে সতের ঘণ্টা, কেউ উনিশ। আমাদের মতো মাঝারি মানের ছাত্রদের বাধ্যতামূলকভাবে সেই সব অনুষ্ঠান দেখতে হতো। উনিশ ঘণ্টা ক্লাসের বই পড়া? শুনেই দম আটকে আসত আমার; তাহলে গল্পের বই পড়ব কখন? আড্ডা মারব কখন? এইসব মুখ ফুটে বলা বিপজ্জনক, কাজেই চুপচাপ থাকতাম। এসব অনুষ্ঠান দেখেও আচরণের আশানুরূপ পরিবর্তন না দেখায় মুরুব্বিরা গম্ভীর মুখে বলত,

সময় আসুক, ঠিকই বুঝবা, তখন আফসোস করবা!”

সেভেনের সেই রেজাল্টের পর সবার মুখ থমথমে। পারিবারিক আলোচনায় অসংখ্য উপদেশ, এই রেজাল্ট নিয়ে জীবনে কী ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে তার রোমহর্ষক বর্ণনার পর সবশেষে সেই অমোঘ বাক্য “সময় আসুক, একদিন বুঝবা!”

মাঝারি রেজাল্ট করে স্কুল কলেজ পাশ করলাম, মেডিক্যাল বুয়েট না হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উৎরে গেলাম। সেভেনের সেই রেজাল্ট আমার নিজেরই আর মনে রইল না। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে রেজাল্টের লক্ষণীয় উন্নতি হওয়ায় কিছুদিন পর সেই আপ্তবাক্য পড়ালেখা ছেড়ে অন্যদিকে ঘুরে গেলো।

রান্নাবান্না কিছুই শেখ নাই? ঘরের কাজও তো পারো না। জীবন চলবে কেমনে? এখন তো বুঝতেস না; সময় আসুক, একদিন বুঝবা!”

সেই একদিনের আশঙ্কা বুকে নিয়েই পড়ালেখা শেষ করলাম। আঁকাআঁকি করি, উন্মাদে যাই, নিউ এইজে কার্টুন আঁকি। সবার মুখে হাসি ফুটিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করলাম। সামাজিক বিচারে এলিট শ্রেণিতে নাম লেখালাম, ভাবলাম এবার মুক্তি! কিন্তু না!

এখনো বিয়ে করো নাই? বয়স তো চলে যায়! আজকালকার মেয়েরা ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটতে ছুটতে সংসার ভুলে যায়। সময় আসুক, একদিন বুঝবা কতবড় ভুল করতেস!”

রাজশাহীতে একার সংসার। ক্লাসে মহা উৎসাহে ছাত্র পড়াই, নিজের ঘরে বসে কার্টুন আঁকি; সপ্তাহান্তে ঢাকায় এসে বাসায় সময় কাটাই, উন্মাদে গিয়ে আড্ডা দিই; নিরুদ্বেগ জীবন! এদিকে চারপাশ থেকে একটাই কথা, “একদিন বুঝবা!” চেনা, অচেনা, আধচেনা মানুষজন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়ে যাচ্ছে, সবারই দেখছি পরিচিত কোনো না কোনো ‘এলিজিবল ব্যাচেলর’ আছে।

এই যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে এমনটা নয়; বরং নিজের পছন্দেই একসময় বিয়ে করে ফেললাম, সামাজিক বিচারে সামান্য ‘বেশি বয়সে’ যদিও। ভাবলাম, এবার তো আর চিন্তা নাই, প্রপার সামাজিক জীবন!

কিন্তু না, ছয় মাস না যেতেই নতুন পেরেশানি, “বাচ্চা নেবে কবে?”

প্রথম প্রথম দুইজন এই প্রশ্ন হাসিমুখে এড়িয়ে যাই, তারপর থেকে যারা বলে তাদেরকেই এড়াতে শুরু করি; কিন্তু আলোচনা থামে না। বয়স বেড়ে যাচ্ছে, মেয়েদের বাচ্চা মানুষ করাই আসল কাজ, মা হওয়াটাই আসল ক্যারিয়ার, ইত্যাদি ইত্যাদি বহু বাক্যের পর আসে সেই অমোঘ বাক্য, “সময় আসুক, একদিন বুঝবা!”

এই বাক্য এক কান দিয়ে শুনতে শুনতে এতদিনে আরেক কান দিয়ে বের করাও শিখে গেছি। এদিকে সময় গড়ায়, আমরা আমাদের দুই শহরে পেতে রাখা ভ্রাম্যমান সংসারে অভ্যস্ত হয়ে উঠি। তবে কথায় আছে সুখে থাকলে মানুষ ভুতের কিল খায়; আমি খেলাম ব্রহ্মদত্যির কিল! পরিবার-পরিজন-শুভানুধ্যায়ী সবার হৃদয় ভেঙে দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্বাধীন পেশায় ফিরলাম। নিজের মতো কাজ বাছি, কাজ করি, ইনকাম যা হয় তাতে আমার ভালভাবেই চলে যায়। সময়ে অসময়ে নানা জনের আফসোস,

এমন চাকরি কেউ ছাড়ে? বয়স কম তো, তাই বুঝতেস না। সময় আসুক, একদিন বুঝবা!”

এদিকে বাচ্চা নেয়া বিষয়ক প্রশ্নবাণও থেমে নেই। এভাবেই বেশ কিছু বছর কাটে, একসময় আমরা সত্যি সত্যি পরিবারে নতুন সদস্য আনতে আগ্রহী হই। তার দেড় বছরের মাথায় আমাদের ঘর থেকে একজন অতিদুরন্ত কন্যাশিশুর গলা শুনতে পাওয়া যায়।

পড়ালেখা-ক্যারিয়ার-বিয়ে-বাচ্চা সব তো হলো, ভাবলাম আমাদের নিয়ে লোকের আফসোসের কাল তবে শেষ হল! দুইজন মহাসুখে বাচ্চা পালি, ঘরের-বাইরের কাজকর্ম করি; মোটামুটি নির্বিঘ্ন জীবন।

অনু, মানে আমাদের মেয়ের বয়স আট মাস হলো। সদ্য সলিড খাবার শুরু করেছে, বিভিন্ন খাবারের স্বাদের সাথে পরিচিত হচ্ছে, আমাদের খাবার টেবিলে ছোট ছোট থালাবাটির সংযোজন ঘটছে। সে যা খায়, তার চেয়ে বেশি মাখে, আমরা দুইজন সেই দৃশ্য মুগ্ধ হয়ে দেখি। যখন আমাদের অবাক করে অতিদ্রুত সে কিছু শিখে ফেলে, আমরা আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই। মেয়ের জন্মের পর আমাদের ফোন এবং টিভির ব্যবহার আগের চেয়েও কমে গেছে, বাচ্চার স্ক্রিনে আসক্তি যাতে না হয় তার শুরু হিসেবে নিজেদের আসক্তি কমানোর চেষ্টায় আছি দুইজনেই। সেদিন এক দাওয়াতে গেলাম, সেখানে বিভিন্ন বয়সী বাচ্চাকাচ্চা, এবং বিভিন্ন বয়সী বাবা-মা। বছর তিনেকের এক পিচ্চিকে খাওয়ানোর জন্য এক মা প্লেটে খাবার মেখে বসেছে। এদেশের খুব সাধারণ দৃশ্য, ভদ্রমহিলা নিজের স্মার্টফোনে কিছু একটা চালু করে পিচ্চির হাতে দিল; পিচ্চি সম্মোহিতের মত সেই জিনিস দেখতে দেখতে হাঁ করছে, আর তার মা সেখানে খাবার পুরে দিচ্ছে। আমাদের চেহারায় জাজমেন্টাল ভাব যাতে ফুটে না ওঠে সেজন্য আমরা অন্যদিকে তাকিয়ে খেয়ে নিচ্ছি। একসময় উনি নিজেই বলে ওঠেন,

ভাবী, বাচ্চাকে ফোন দেন না? খাওয়ান কীভাবে?”

ফোন দেই না আপা, এমনিতেই খায়।”

তাহলে কি টিভি দেখতে দেখতে খায়?”

না আপা, ও নিজের ইচ্ছাতেই খায়। আর খেতে না চাইলে জোর করে খাওয়াই না।”

ভদ্রমহিলা চোখ কপালে তুলে তাকালেন, উত্তর খুঁজছেন। অনুর দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন। তারপর হাসিমুখে তাকিয়ে বললেন,

ওহ! আপনার বাচ্চা তো ছোট! বড় হলে ঠিকই সামনে ফোন দেয়া লাগবে! না দিলে খাবেই না!”

আমরা একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করলাম, ফোন সামনে নিয়ে খাওয়ানোর অভ্যেস আমরা না করালে এই অভ্যেস নিজে নিজে কীভাবে হবে? ভদ্রমহিলা আমাদের প্রশ্নকে উড়িয়ে দিয়ে ছাড়লেন সেই ব্রহ্মাস্ত্র!

নিজেদের সময় আসুক, একদিন ঠিকই বুঝবেন!”

আপাতত আমরা সেই ‘একদিনের’ অপেক্ষায় আছি।

সম্ভবত বাকি জীবন এই অপেক্ষাতেই কাটবে।

Tuesday, October 31, 2023

হাসনাহেনার ঝাড় (পর্ব: শিউলী ফুলের ঘ্রাণ)

শরৎ দিনের সকাল বেলা,
শিউলি ফুল ওই করছে খেলা।
উঠোন ছেয়ে লুটোয় হেসে,
বোঁটায় হলুদ মোহন বেশে।
ছোট্ট মেয়ে মালা গাঁথে,
ফুল নিয়ে ওই কলার পাতে।
শরৎ হাসে সোনার হাসি,
রাখাল ছেলে বাজায় বাঁশি।

এই ছড়া কার লেখা জানা নেই। তবে ছড়াটা এবং তার সাথের অলঙ্করণ এখনো স্পষ্ট মাথায় গেঁথে আছে। অতি ব্যবহারে আমাদের ছোটকালেই বইটার আয়ু ফুরিয়েছে, পরে বহু খুঁজেও আর পাইনি। ছবিটা খুব সম্ভবত বিমল দাসের আঁকা ছিল। তবে অলঙ্করণ চাইলেও ভোলা সম্ভব হত না, কারণ বইপত্রে কোনো সুন্দর ছবি দেখলেই আম্মু তার একটা খাতায় দেখে দেখে সেই ছবি কপি করে রাখত। পরে কোনো টি-কোজি, টেবিলক্লথে, বা কুশনের কভারে শোভা পেত এম্ব্রয়ডারি করা সেই ছবি। লালপেড়ে সবুজ শাড়ি পরা বালিকার শিউলি মালা গাঁথার সেই ছবি এখনো বাসার পুরনো একটা টেবিলক্লথে যত্নে আছে, ৩৪/৩৫ বছরে সুতার রং কিছুটা ফিকে হয়েছে- এই যা। 

তিন দশকেরও বেশি আগে আম্মুর করা এম্ব্রয়ডারি, সেই শিউলি মালা



ভাগ্যিস, তখন কপিরাইট আর প্লেজারিজম নিয়ে বাসাবাড়িতে কেউ মাথা ঘামাত না!

শিউলি ফুলের সাথে আম্মুর গায়ের ঘ্রাণ আমার স্মৃতিতে কেমন এলোমেলো হয়ে মিশে থাকে। সবচেয়ে পুরনো স্মৃতিরও আগে, একেবারে ছোট্টবেলার যে কটি খাপছাড়া ছবি মাথার কোনো কোণে বিচিত্রভাবে থেকে গেছে, তার মধ্যে একটা হলো এই শিউলি ফুল কুড়ানোর ছবি। তখন আব্বুর পোস্টিং সিলেটে, আমাদের সরকারি বাসার ঠিক সামনেই বোধ হয় ছিল একটা মস্ত বড় (অন্তত তখন তাই মনে হতো) শিউলি গাছ। খুব ভোরে হিম হিম বাতাসে আম্মু আর আমরা দুই বোন শিউলি কুড়িয়ে নিয়ে এসেছি, কিছুক্ষণ পর ড্রইংরুমে একটা ছোট ঝুড়িতে রাখা সেই ফুলের গায়ে বিন্দু বিন্দু শিশির; এই অকারণ ছবিটা এত বছর পরেও একেবারে স্পষ্ট যেন দেখতে পাই!

মানুষের স্মৃতি বড়ই অদ্ভুত। খুব প্রয়োজনীয় অনেক কিছু যেমন ভুলে গেছি, আবার খুব অদরকারি সব ঘটনা এমনভাবে মনে পড়ে যেন এই সেদিনের কথা। ময়মনসিংহে আমরা যেই বাসায় প্রায় বছর দশেক ছিলাম, সেই বাসার রুমগুলো কেমন ছিল আমার কেন যেন ঠিকমত মনে পড়ে না। অথচ, পাশেই রেস্টহাউজের টেরেসে ফোটা অলকানন্দা ফুলের রং আর টেক্সচার কেমন ছিল তা এতকাল পরেও এত স্পষ্ট মনে পড়ে। 

ময়মনসিংহের বাসায় অনেক ফুলের গাছ ছিল, কিন্তু কোনো শিউলি গাছ ছিল না। এ নিয়ে আমার খুব দুঃখ ছিল, সিলেটের বাসার সেই শিউলি ফুলের কথা ভেবে প্রায়ই মন খারাপ হতো। একবার ক্লাস টু তে থাকতে এক বন্ধু এনে দিল এক মুঠ শিউলি ফুলের বীজ; সেই গাছ লাগানো নিয়ে আমার সে কি উত্তেজনা! প্রথম যেদিন আম্মু সকালে ডেকে তুলে দেখালো আমার নিজের গাছে ফোটা প্রথম শিউলি ফুল, সে দিনের মতো আনন্দ আমি এই জীবনে খুব বেশি আর পাইনি। 

ফুল গাছ নিয়ে আম্মু এবং আমাদের দুই বোনের উত্তেজনা ছিল দেখার মতো। সরকারি বাসায় থাকার কারণে বাসার সামনে বড়সড় একটা বাগান ছিল আমাদের। বাসা থেকে কয়েক গজ দূরে বিটিভির অফিসের সামনের বাগানটা ছিল আরো একটু বড়। প্রতি শীতে যখন মৌসুমী ফুলের গাছ লাগানোর তোড়জোড় শুরু হতো, আমরা তিনজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম; কী কী রঙের জিনিয়া ফুল ফুটবে এবার? ডালিয়া ফুলের গাছ লাগানো হলো কয় রঙের? অফিসের মালী গণি কাকাকে জিজ্ঞেস করলে কুচকুচে কালো মানুষটা তার ঝকঝকে দাঁত বের করে হেসে বলতেন, "ফুল ফুটুক, নিজেই দেখবা!"

আম্মুর সবচেয়ে প্রিয় ফুল ছিল বেলী। গাছভর্তি ধবধবে সাদা বেলীফুলের উপর যখন আষাঢ়ের বৃষ্টি ঝিরঝির করে পড়ত, আম্মু জানালা দিয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখত সেই দৃশ্য। সকল সুগন্ধি সাদা ফুল ছিল আম্মুর প্রিয়। তবে সাদা কখনও তার প্রিয় রং ছিল না; বরং প্রিয় ছিল উজ্জ্বল মেরুন, ফিরোজা, গেরুয়ার শেড। ম্যাড়মেড়ে রঙের শাড়ি কোনোকালেই শখ করে তাকে পরতে দেখিনি। বড় হয়ে আমাদের যখন সাদা বা ছাই রঙের শাড়ির প্রতি ভালবাসা জন্মালো, তা দেখেও তার অনুযোগের শেষ ছিল না। 

এক সকালের কথা খুব মনে পড়ে। ঝমঝমে বর্ষার দিন, আম্মুর ডাকাডাকিতে কাকভোরে ঘুম ভাঙল; দেখি উত্তেজনায় আম্মু কিশোরী মেয়েদের মতো ঝলমল করছে, "তাড়াতাড়ি বাইরে এসে দেখো!"

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি হতভম্ব, বাসার সামনে খোলা জায়গায় থই থই পানি, তার মধ্যে যেদিকে চোখ যায় শত শত সোনাব্যাঙ, তারস্বরে ডেকে চলেছে। তাদের গায়ের সবুজ সোনালী রঙে পুরো মাঠ ঝলমল করছে। 

স্মৃতিশক্তি কম বলেই বোধ হয়, ছোটবেলার বেশির ভাগ ঘটনার ক্ষেত্রেই আমার রং আর ঘ্রাণ ছাড়া তেমন কিছুই মনে পড়ে না। ছোটবেলার স্মৃতিতে আম্মুকে আমার মনে হয় যেন একটা রংভর্তি প্যালেট, যেখানে কোনো শিশু ভাবনাহীনভাবে হাজার রঙের টিউব ঢেলে দিয়েছে। 

সেই আম্মুকে আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে শেষ সাদা কাপড়ে রেখে এসেছি। আম্মুকে সাদা রঙে কোনোদিন মানায়নি, সেদিনও না। 
২০১৩ সালে করা কুইক স্কেচ... যখন চাইলেই সামনে বসে আম্মুকে আঁকা যেত


Friday, April 07, 2023

হাসনাহেনার ঝাড় (পর্ব: প্রথম ইশকুল)

আমার জীবনে শেখা প্রথম কঠিন বানান হলো ENGINEER। 

বাপ রে, কত্তগুলো অক্ষর! বানানের সাথে উচ্চারণের মিল থাকলেও না হয় মনে রাখা যেত! তাও না। ইঞ্জিনিয়ার যদি হয় উচ্চারণ, তবে বানানটা হবার কথা INJINIAR। এমন আজব কেনো বানানের নিয়ম তা আমার ছোট মাথায় ঢুকতই না। 

EN-GI-NEER, আম্মু এভাবে ভেঙে ভেঙে শেখাত। বড় শব্দকে তিন টুকরা করে, ভাত খাওয়ানোর সময় বড় লোকমাকে ছোট ছোট করে পায়রার ডিম, মুরগির ডিম বানিয়ে যেভাবে খাওয়াত, অনেকটা সেভাবে। তো ঐ বয়সে এই শব্দ শেখার দরকার কেনো পড়ল? ওই যে- স্কুলে ইংরেজি ক্লাসে যখন নিজের সম্পর্কে লিখতে হতো, ‘My father is an engineer, my mother is a housewife…’। তখন মনে হতো, আব্বু ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে সহজ কিছু কেনো হলো না- এই যেমন Farmer, Doctor, এরকম কিছু। এক বন্ধুর বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী, তাকে ‘My father is a businessman’ লিখতে দেখে আমার রীতিমত মায়াই লেগেছিল! 

এইটুকু পড়ে মনে হতে পারে, কঠিন কঠিন শব্দে অনেক ভীতি ছিল আমার। কথাটা আংশিক সত্যি। ইংরেজি গল্পের বই আম্মু টুকটাক পড়ে শোনাতো বটে, কিন্তু কঠিন শব্দ বানান বুঝে পড়া তখনো শিখিনি। বাংলা বরং অনেক সোজা, গল্প আর ছড়ায় কঠিন কঠিন শব্দগুলোও কী সুন্দর ঠিক ঠিক এঁটে যায়! আম্মু আমাদের দুই বোনকে কোলের উপর বসিয়ে যখন ‘পুরাতন ভৃত্য’ বা ‘দুই বিঘা জমি’ আবৃত্তি করে শোনাতো, মোটেও কঠিন মনে হতো না লাইনগুলো। তবে এগুলো বড় দুঃখের কবিতা। আমার বেশি প্রিয় ছিল ‘খাঁদু দাদু’ আর ‘লিচু চোর’। 

দুঃখের কবিতাগুলো আমার কাছে মনে হতো যেন ঠিকমত শেষ হয়নি, যেন আরো কিছু ঘটার কথা ছিল। ‘পুরাতন ভৃত্য’ পড়ে একেবারে মুষড়ে গেছিলাম, কেষ্টা যে একেবারে মরেই গেল! মরে যাবার পরে যে আর কিছু ঘটবার থাকে না তা বোঝার বয়স তখনই হয়েছিল। 

তবে আম্মু বোধ হয় তার বছর পাঁচেকের কন্যার মন খারাপটা দেখতে চায়নি। তাই আমাদের পড়ে শোনানোর সময় কবিতার শেষটুকু প্রায়ই বদলে যেত। ‘দুই বিঘা জমি’ তে জমিদারবাবু উপেনের জমি কীভাবে ‘ডিক্রি’ জারি করে হাতিয়ে নিল তা আমি মেনেই নিতে পারতাম না। বলতে গেলে বাধ্য হয়েই, আম্মু কবিতার শেষটা সামান্য পাল্টে দিলো। তাই আমার ছোটবেলার স্মৃতিতে ‘দুই বিঘা জমি’তে পুরোদস্তুর হ্যাপি এন্ডিং, কবিতার শেষ লাইন আর উপেনের মুখে রইলো না। বরং শেষ দৃশ্যে বাবু নিজেই তার ভুল বুঝতে পেরে উপেনের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছে,

‘তুমি মহারাজ, সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।’

পরপারে বসে রবি ঠাকুর নিশ্চয়ই আম্মুর এই নিদারুণ অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন!

রবীন্দ্র-নজরুলের সাথে আম্মুর এই সখ্যতার কারণে আমাদের ভাণ্ডারে শব্দের কমতি ছিল না। একবার থ্রি-ফোরে থাকতে একটা কঠিন বাংলা শব্দ শেখা হলো- ‘পৃষ্ঠ-পো-ষ-ক-তা’, কোন বই থেকে পড়েছিলাম এখন আর মনে নেই। তবে বেশ পছন্দ হলো শব্দটা, মুর্ধন্য-ষ, ঠ, ক, ত মিলিয়ে বেশ একটা এলাহি অবস্থা, লিখতে গেলেই নিজের মধ্যে বেশ জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব চলে আসে। প্রথম সুযোগেই এই শব্দ চালিয়ে দিয়েছিলাম বাংলা পরীক্ষার খাতায়, বাংলা শিক্ষকের অবাক করা চেহারা দেখে বেশ একটা গর্বও হয়েছিল মনে পড়ে। সেই গর্ব ভাঙতে বেশিদিন লাগে নি, তবে সে কথায় পরে আসি।

সত্যি বলতে, তখন পর্যন্ত স্কুল আমার বেশ ভালই লাগত। আসলে স্কুল যে একটা টর্চার সেল, সেটা বুঝেছি বেশ কবছর স্কুলে যাবার পর। এটার বড় কারণ খুব সম্ভবত প্রথম স্কুলের অভিজ্ঞতা। প্রথম স্কুল বলতে আমাদের কাছে যা ছিল তা হলো সন্ধ্যাবেলায় আম্মুর কাছে পড়তে বসা। তবে সে স্কুলেও কায়দা কানুনের অভাব ছিল না। সিরামিক আর মেলামাইনের ভরভরন্ত কালের আগে মধ্যবিত্ত বাসাবাড়িতে খাওয়া হতো স্টিলের প্লেটে। সেই স্টিলের প্লেট আর ভাতের চামচ হতো আমাদের স্কুলের ঘণ্টা। আমরা দুই বোন গম্ভীর মুখে ব্যাগে বইপত্র নিয়ে রেডি হয়ে পাশের ঘরে অপেক্ষা করতাম, আর ঘণ্টা পড়লেই আমাদের ছোট্ট পড়ার টেবিলে এসে বসতাম। আম্মু হতো ক্লাস টিচার, আর টিফিনে থাকত বাসায় বানানো হালকা পাতলা নাশতা। এই স্কুলের বইপত্র ছিলো বিচিত্র। কলকাতায় ছাপা বিমল দাসের আঁকা ছবির সাথে ছড়া আর গল্পের বই থাকতই, আর থাকত এপার-ওপার বাংলা মিলে নানা জাতের বাংলা বর্ণ আর শব্দ শেখার বই, তবে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় ছিল টোনাটুনির ক্যাসেট। মজিবুর রহমান দিলু, যাকে আমরা সংশপ্তকের ‘মালু’ নামেই চিনতাম, তার ভরাট গলায় যখন বেজে উঠত ‘এবার ক্যাসেটটা উল্টিয়ে দিয়ে শোনো…’, আমাদের দুই বোনের কাড়াকাড়ি লেগে যেত কে আগে গিয়ে ক্যাসেট ওল্টাবে। 


(চলবে)

Tuesday, November 22, 2022

হাসনাহেনার ঝাড় (ভূমিকা পর্ব)

 “You want to know so much about his death, but what do you know about his life?” 

~ Loving Vincent


আম্মু চলে যাবার আজকে ২২তম দিন। জীবনের কঠিনতম তিনটি সপ্তাহ আইসিইউর সামনে কাটানোর পর গত এই কটি দিন কীভাবে গিয়েছে আমরা কেউই জানিনা। হাসপাতালের পুরো সময় শুভাকাঙ্খিরা সমবেদনা জানিয়েছেন, খোঁজ নিয়েছেন। আত্মীয়-অনাত্মীয়রা অপ্রত্যাশিত ভালবাসা যেমন দেখিয়েছেন, পাশেও দাঁড়িয়েছেন সকল প্রয়োজনে। 

তারপর এক বিষণ্ণ ভোরে আমাদের সব প্রয়োজন ফুরালো, আমাদের আটকে থাকা নিঃশ্বাসটা দীর্ঘশ্বাস হয়ে ঠিকানা হারালো। এমন ঘটনায় কাছের-দূরের সকলে দুঃখিত হয়, সমব্যাথী হতে চায়। জানতে চায়- কী হয়েছিল? কীভাবে এমন হলো? আর কি কিছু করার ছিল না?... সংক্ষেপে উত্তর দিই। কিন্তু উত্তরের পিঠে চেপে আসে আরো বহু প্রশ্ন- সার্জারি, ভেন্টিলেশন, আইসিইউ... পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম শব্দগুলো সুঁচের মত গেঁথে গেঁথে বসে বুকে পিঠে। দ্রুত কথা সেরে প্রসঙ্গ পাল্টাই। পরদিন আবার, অন্য কেউ, অন্য কোথাও, একরাশ দুঃখ নিয়ে জানতে চায়- কী করে হলো?... 

হঠাৎ আবিষ্কার করি, মানুষ আসলে জীবনের চেয়ে মৃত্যু নিয়ে বেশি কৌতূহলী। অথচ মৃত্যু কি আশ্চর্য নির্বিকার একটা ঘটনা, যেখানে এসে সব মানুষ মিলে মিশে এক হয়ে যায়। ঠিক যেমন কবরস্থানের সারি বেঁধে শুয়ে থাকা মানুষগুলোকে দেখতে হুবহু একই মনে হয়। মৃত্যুর আয়োজনটাও তো একইরকম নির্বিকার- যেকারণে আইসিইউতে সারি সারি বেডে শুয়ে থাকা মানুষগুলোকে হঠাৎ করে দেখলে আশ্চর্যজনকভাবে একইরকম দেখায়! অথচ এই নৈব্যক্তিক বিষয়াদি দিয়েই আমরা জানতে চাই, চিনতে চাই, সংজ্ঞায়িত করতে চাই মানুষকে। এ কী ভীষণ অন্যায়! 

প্রতিটি মানুষ যদি অনেকগুলো গল্পের সমষ্টি হয়, তবে সেই গল্পগুলোই তো তার সত্ত্বা, তাকে চেনার, জানার, ছুঁয়ে দেখার উপায়। আম্মুর গল্পগুলো তাই আমি খুব করে বলতে চাই। মনে না থাকা শৈশবে, যেই স্মৃতি বা বিস্মৃতিতে শিউলী ফুলের ঘ্রাণকে কিছুতেই আমি আম্মুর শাড়ির ঘ্রাণ থেকে আলাদা করতে পারিনা; সেই ভুলে যাবার কালে- যেসময়ের টুকরো স্মৃতিতে হঠাৎ হঠাৎ আম্মুর হাসির পাশে উঁকি দেয় বারান্দায় ফোটা সূর্যমুখী ফুল; সেই সময়ের ঘ্রাণ আমি টুকে রাখতে চাই। এই গল্পগুলো বলার আয়োজন হয়ত বড় বেশি ব্যক্তিগত, তাতে কী?

এই যাহ, বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম।

শুভ জন্মদিন আম্মু!

নভেম্বর ২২, ২০২২

Sunday, February 20, 2022

নতুন শিক্ষাক্রম রূপরেখা: বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব কী কমে যাচ্ছে?

এই লেখাটা গত ২৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ সারাবাংলা ডট নেটে প্রকাশিত হয়। আগেই বলে রাখা ভাল, গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে যে কাজ নিয়ে নাক পর্যন্ত ডুবে আছি তা হল প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণির অবিচ্ছিন্ন শিক্ষাক্রম রূপরেখা, এবং তার আলোকে নতুন শিক্ষাক্রম ও বই পুস্তক তৈরি। শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আমরা চুন খেয়ে মুখ পোড়ানো জাতি, কাজেই যেকোন নতুন উদ্যোগ নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা হবার কথা, সেটাই হচ্ছিল এবং এখনো হচ্ছে! নতুন রূপরেখায় বেশ বড় বড় কয়েকটি পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে- তার মধ্যে একটা হল নবম-দশম শ্রেণিতে সায়েন্স, আর্টস, কমার্স বিভাগ না রেখে সবার জন্য অভিন্ন বিষয়ের ব্যবস্থা। এই বিষয়টা নিয়ে চারপাশে বহু আলোচনা শুনেছি, পক্ষে বিপক্ষে নানা যুক্তি দেখেছি। এই বিশাল কর্মযজ্ঞের শুরু থেকেই এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকার সুবাদে বিষয়টা নিয়ে কিছু কথা বলার দরকার মনে হল, তাই এই লেখা। গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হলেও আজ মনে হল, নিজের ব্লগেও লেখাটা টুকে রাখা দরকার- 

Thursday, December 31, 2020

বিদায় বিষাদের বিশ!

কৈশোর পেরোবার পরপর কোন এক শান্ত সন্ধ্যায় গোলাপী আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় কারণ খুঁজে পেয়েছিলাম- তা হল আনন্দ! স্ফুলিঙ্গের মত অর্থহীন কিন্তু প্রাণময় উজ্জ্বল একটা আগুনের কণার মত বেঁচে থাকে একেকটা মানুষ। সর্বাংশে না হোক, বেঁচে থাকার এই ছোট্ট সময়টা অন্তত কিছুটা আনন্দে না থাকলে যেন সেই জীবনটার প্রতি অর্ঘ্য নিবেদন ঠিকভাবে সম্পন্ন হয় না!

সেই বিকেলের পর থেকে আমি বোধহয় জীবনে একটা দিনও শতভাগ খারাপ ভাবে পার করি নি। কিন্তু অর্থহীন জীবনের ততোধিক অর্থহীন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখে হয়ত অনেক সময় সন্ধ্যার আকাশের রঙ পালটানো দেখতে ভুলে গিয়েছি, হয়ত শরতের অনেক কাশফুলের কণা ছুঁতে এসে অপ্রস্তুত হয়ে ফিরে গেছে। এভাবেও জীবনটা খারাপ কাটছিল তা নয়, কিন্তু হেমন্তের আকাশে কালপুরুষকে একটু অপেক্ষা করতে বলে আমি যে সেকথা বেলামুল ভুলে গিয়েছিলাম তার দায় কে নেবে? ব্যস্ত ছিলাম, তবে দিনগুলো কাটছিল মন্দ নয়, কিন্তু সব তালগোল পাকিয়ে দিল এই দুহাজার বিশ। কাঁধ ধরে শক্ত ঝাঁকুনি দিয়ে বলল- ওঠ ওঠ, বেলা যে বয়ে যায়! জীবন হাত খুলে যা মণিমাণিক্য ছড়িয়ে দিল, তা কুড়িয়ে নেয়া হল কই?

বিষাদের এই দুহাজার বিশ কেড়ে নিয়েছে অনেকের অনেক প্রিয়জনকে, অনেকের বেঁচে থাকাকে করেছে মৃত্যুর চেয়েও কঠিন। সেদিক দিয়ে দেখলে নিজেকে সৌভাগ্যবান বলতেই হয়- কোভিড নামক বিচ্ছিরি অসুখটা আমার জীবন থেকে দুমাস সময় চেয়ে নিয়েছে বড়জোর। কিন্তু সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকার যেই অভিনয়, সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে একটা বিষম টিটকারিও দিয়ে গেছে বলতেই হয়!

সাথে এ-ও মনে করিয়ে দিয়েছে- কতদিন শুক্লপক্ষের চাঁদের আলোয় মেঘেদের সভা দেখা হয়নি!