শরৎ দিনের সকাল বেলা,
শিউলি ফুল ওই করছে খেলা।
উঠোন ছেয়ে লুটোয় হেসে,
বোঁটায় হলুদ মোহন বেশে।
ছোট্ট মেয়ে মালা গাঁথে,
ফুল নিয়ে ওই কলার পাতে।
শরৎ হাসে সোনার হাসি,
রাখাল ছেলে বাজায় বাঁশি।
এই ছড়া কার লেখা জানা নেই। তবে ছড়াটা এবং তার সাথের অলঙ্করণ এখনো স্পষ্ট মাথায় গেঁথে আছে। অতি ব্যবহারে আমাদের ছোটকালেই বইটার আয়ু ফুরিয়েছে, পরে বহু খুঁজেও আর পাইনি। ছবিটা খুব সম্ভবত বিমল দাসের আঁকা ছিল। তবে অলঙ্করণ চাইলেও ভোলা সম্ভব হত না, কারণ বইপত্রে কোনো সুন্দর ছবি দেখলেই আম্মু তার একটা খাতায় দেখে দেখে সেই ছবি কপি করে রাখত। পরে কোনো টি-কোজি, টেবিলক্লথে, বা কুশনের কভারে শোভা পেত এম্ব্রয়ডারি করা সেই ছবি। লালপেড়ে সবুজ শাড়ি পরা বালিকার শিউলি মালা গাঁথার সেই ছবি এখনো বাসার পুরনো একটা টেবিলক্লথে যত্নে আছে, ৩৪/৩৫ বছরে সুতার রং কিছুটা ফিকে হয়েছে- এই যা।
তিন দশকেরও বেশি আগে আম্মুর করা এম্ব্রয়ডারি, সেই শিউলি মালা |
ভাগ্যিস, তখন কপিরাইট আর প্লেজারিজম নিয়ে বাসাবাড়িতে কেউ মাথা ঘামাত না!
শিউলি ফুলের সাথে আম্মুর গায়ের ঘ্রাণ আমার স্মৃতিতে কেমন এলোমেলো হয়ে মিশে থাকে। সবচেয়ে পুরনো স্মৃতিরও আগে, একেবারে ছোট্টবেলার যে কটি খাপছাড়া ছবি মাথার কোনো কোণে বিচিত্রভাবে থেকে গেছে, তার মধ্যে একটা হলো এই শিউলি ফুল কুড়ানোর ছবি। তখন আব্বুর পোস্টিং সিলেটে, আমাদের সরকারি বাসার ঠিক সামনেই বোধ হয় ছিল একটা মস্ত বড় (অন্তত তখন তাই মনে হতো) শিউলি গাছ। খুব ভোরে হিম হিম বাতাসে আম্মু আর আমরা দুই বোন শিউলি কুড়িয়ে নিয়ে এসেছি, কিছুক্ষণ পর ড্রইংরুমে একটা ছোট ঝুড়িতে রাখা সেই ফুলের গায়ে বিন্দু বিন্দু শিশির; এই অকারণ ছবিটা এত বছর পরেও একেবারে স্পষ্ট যেন দেখতে পাই!
মানুষের স্মৃতি বড়ই অদ্ভুত। খুব প্রয়োজনীয় অনেক কিছু যেমন ভুলে গেছি, আবার খুব অদরকারি সব ঘটনা এমনভাবে মনে পড়ে যেন এই সেদিনের কথা। ময়মনসিংহে আমরা যেই বাসায় প্রায় বছর দশেক ছিলাম, সেই বাসার রুমগুলো কেমন ছিল আমার কেন যেন ঠিকমত মনে পড়ে না। অথচ, পাশেই রেস্টহাউজের টেরেসে ফোটা অলকানন্দা ফুলের রং আর টেক্সচার কেমন ছিল তা এতকাল পরেও এত স্পষ্ট মনে পড়ে।
ময়মনসিংহের বাসায় অনেক ফুলের গাছ ছিল, কিন্তু কোনো শিউলি গাছ ছিল না। এ নিয়ে আমার খুব দুঃখ ছিল, সিলেটের বাসার সেই শিউলি ফুলের কথা ভেবে প্রায়ই মন খারাপ হতো। একবার ক্লাস টু তে থাকতে এক বন্ধু এনে দিল এক মুঠ শিউলি ফুলের বীজ; সেই গাছ লাগানো নিয়ে আমার সে কি উত্তেজনা! প্রথম যেদিন আম্মু সকালে ডেকে তুলে দেখালো আমার নিজের গাছে ফোটা প্রথম শিউলি ফুল, সে দিনের মতো আনন্দ আমি এই জীবনে খুব বেশি আর পাইনি।
ফুল গাছ নিয়ে আম্মু এবং আমাদের দুই বোনের উত্তেজনা ছিল দেখার মতো। সরকারি বাসায় থাকার কারণে বাসার সামনে বড়সড় একটা বাগান ছিল আমাদের। বাসা থেকে কয়েক গজ দূরে বিটিভির অফিসের সামনের বাগানটা ছিল আরো একটু বড়। প্রতি শীতে যখন মৌসুমী ফুলের গাছ লাগানোর তোড়জোড় শুরু হতো, আমরা তিনজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম; কী কী রঙের জিনিয়া ফুল ফুটবে এবার? ডালিয়া ফুলের গাছ লাগানো হলো কয় রঙের? অফিসের মালী গণি কাকাকে জিজ্ঞেস করলে কুচকুচে কালো মানুষটা তার ঝকঝকে দাঁত বের করে হেসে বলতেন, "ফুল ফুটুক, নিজেই দেখবা!"
আম্মুর সবচেয়ে প্রিয় ফুল ছিল বেলী। গাছভর্তি ধবধবে সাদা বেলীফুলের উপর যখন আষাঢ়ের বৃষ্টি ঝিরঝির করে পড়ত, আম্মু জানালা দিয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখত সেই দৃশ্য। সকল সুগন্ধি সাদা ফুল ছিল আম্মুর প্রিয়। তবে সাদা কখনও তার প্রিয় রং ছিল না; বরং প্রিয় ছিল উজ্জ্বল মেরুন, ফিরোজা, গেরুয়ার শেড। ম্যাড়মেড়ে রঙের শাড়ি কোনোকালেই শখ করে তাকে পরতে দেখিনি। বড় হয়ে আমাদের যখন সাদা বা ছাই রঙের শাড়ির প্রতি ভালবাসা জন্মালো, তা দেখেও তার অনুযোগের শেষ ছিল না।
এক সকালের কথা খুব মনে পড়ে। ঝমঝমে বর্ষার দিন, আম্মুর ডাকাডাকিতে কাকভোরে ঘুম ভাঙল; দেখি উত্তেজনায় আম্মু কিশোরী মেয়েদের মতো ঝলমল করছে, "তাড়াতাড়ি বাইরে এসে দেখো!"
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি হতভম্ব, বাসার সামনে খোলা জায়গায় থই থই পানি, তার মধ্যে যেদিকে চোখ যায় শত শত সোনাব্যাঙ, তারস্বরে ডেকে চলেছে। তাদের গায়ের সবুজ সোনালী রঙে পুরো মাঠ ঝলমল করছে।
স্মৃতিশক্তি কম বলেই বোধ হয়, ছোটবেলার বেশির ভাগ ঘটনার ক্ষেত্রেই আমার রং আর ঘ্রাণ ছাড়া তেমন কিছুই মনে পড়ে না। ছোটবেলার স্মৃতিতে আম্মুকে আমার মনে হয় যেন একটা রংভর্তি প্যালেট, যেখানে কোনো শিশু ভাবনাহীনভাবে হাজার রঙের টিউব ঢেলে দিয়েছে।
সেই আম্মুকে আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে শেষ সাদা কাপড়ে রেখে এসেছি। আম্মুকে সাদা রঙে কোনোদিন মানায়নি, সেদিনও না।
২০১৩ সালে করা কুইক স্কেচ... যখন চাইলেই সামনে বসে আম্মুকে আঁকা যেত |
মা ভালো থাকুক ওপারে। যিনি নিয়ে গেছেন তিনি নিশ্চয়ই যত্নে রেখেছেন।
ReplyDeletePlease read sura ikhlas.even 3 times every day....that'll be rewarded to her as very precious gift to her in that world.
ReplyDeleteShe is always alive in your heart with fond memories & always watching with her precious smile.
ম্যাডাম,আল্লাহ আপনার মাকে জান্নাতের সুুুউচ্চ মাকাম দান করুন আমীন।।মা হারানোর কষ্ট আমি ভালো করে উপলব্ধি করছি। কেননা,গত২৬/০৭/২০২৩ইং তারিখে আমার সবচেয়ে প্রিয় ও আদর্শ অনুকরণীয় মানুষটি আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।আর তিনিই হলেন আমার 'মা'।পৃথিবীর সকল জীবিত মাদেরকে দীর্ঘায়ু দান করুন এবং মৃতদেরকে জান্নাত নসীব করুন,আমীন।।
ReplyDeleteবর্ণনায় বর্ণিল স্মৃতিচারণ।
ReplyDelete❤️❤️🙏
ReplyDelete