Sunday, March 29, 2020

করোনাকালীন যত ভাবনা (১)

[করোনাকালীন এই গৃহবন্দি জীবন শুরু হল যখন ভেবেছিলাম স-অ-ব পেন্ডিং কাজ এবার শেষ করে ফেলব, কিছু কাজ এগিয়েও রাখব... কিন্তু দ্বিতীয়দিনই খুব অদ্ভুতভাবে খেয়াল করলাম কোন কাজেই মন বসানো যাচ্ছে না। নিজেকে হাজার অটোসাজেশন দিয়েও কাজ হচ্ছে না, যেটুকু না করলেই না সেটুকু করছি বটে- কিন্তু নিজের শতভাগ দিয়ে করতে পারছি না। তার সাথে যোগ হয়েছে পুরনো বন্ধু ব্যাকপেইন। একটা বিষণ্ণ পৃথিবীতে ততোধিক বিষণ্ণ সময়ে কেমন যেন একটা বিদঘুটে অনুভূতির মধ্য দিয়ে ঝড়ের বেগে দিনগুলো চলে যাচ্ছে! 

আজকে মনে হল- এই সময়টা লিখে ফেলা উচিত। আমাদের প্রজন্মের  যারা পরে এই সময়ের স্মৃতিচারণ করবে তাদের স্মৃতির উপর ভরসা না করে কিছু একটা লেখা থাকুক! নিজের জন্যেই!! ]

মানুষ নামক বিচ্ছিরি প্রজাতিটা এযাত্রা হয়ত টিকেই যাবে (কতদিনের জন্য সেটা ভিন্ন আলোচনা)! তবে মানুষের ইতিহাসে ২০২০ একটা অদ্ভুতুড়ে বছর হয়েই থাকবে সন্দেহ নেই! কোত্থেকে এক ভাইরাস, যেটা তেমন একটা প্রাণঘাতী নয়, সত্যি বলতে অবিশ্বাস্য দ্রুত ছড়ানো ছাড়া তার তেমন কোন বিশেষত্বও নেই- অথচ গোটা পৃথিবীকে আক্ষরিক অর্থেই স্তব্ধ করে দিয়েছে! অর্থনীতি নামক আপাত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টাকে প্রায়োরিটির বিচারে হাস্যকর বানিয়ে ফেলেছে। সভ্যতার যেসব মাপকাঠি মেনে আমরা গত কয়েক দশক পার করেছি তার সমস্ত কিছুকেই অর্থহীন করে দিয়েছে একটা ক্ষুদ্র জীব!

অবশ্য মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণিদের কাছে ব্যাপারটা সম্ভবত স্বস্তির! প্রকৃতির ক্যান্সার এই মানুষ নামের প্রাণি মোটে সপ্তাহখানেক দরজা বন্ধ করে আছে তাতেই বাতাসে দূষণ কমে গেছে, সৈকতে নেচে বেড়াচ্ছে গোলাপি ডলফিন! গাছপালার সাথে জিনগত পার্থক্য একটুখানি বেশি হওয়ায় তাদের অভিব্যাক্তি বুঝতে পারি না, তারাও নিশ্চয়ই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে কয়দিনের জন্য! 

ভাইরাস নামটা কার জন্য বেশি প্রযোজ্য- মানুষ নাকি করোনা? কে বলতে পারে!

বড় বড় চিন্তা বাদ দেই বরং! কিছু ব্যক্তিগত আলাপ করা যাক। নূহের নৌকায় আমরা কেউই জায়গা পাব কিনা নিশ্চিত নই। এজন্যই হয়ত এই কদিন হুটহাট মৃত্যুচিন্তা আসছে। না- মৃত্যুভয় নয়, বরং মৃত্যুসম্পর্কিত চিন্তা বলা চলে। 

আজ এই মুহূর্তে মারা যাই যদি, আমার জীবনে কী কী আফসোস থাকবে? ছোট ছোট অনেকগুলো কাজ অসমাপ্ত রয়ে যাবে, তবে তা নিয়ে আফসোস নেই। পঁচানব্বই বছর বয়সে মারা গেলেও এরকম অনেক কাজ রয়ে যাবে আমি নিশ্চিত! আর কোন কাজের জন্যেই পৃথিবীতে কেউ অপরিহার্য নয়। অনেকক্ষণ ভেবেও তাই আফসোস হবার মত কিছু মনে পড়ল না। সম্ভবত আমি বিরক্তিকর রকমের সুখী ও ভাগ্যবান একজন মানুষ যার জীবনে বলার মত কোন খেদ নেই। জীবনের কাছে বরং আমি ভীষণরকম ঋণী বলা চলে। কারণগুলো এক এক করে ভাবা যাক-

প্রথমত, ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে আমি স্বাধীন, বলার মত কোন কম্প্রোমাইজের মধ্য দিয়ে আমাকে প্রতিনিয়ত যেতে হয়না। ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ব্লগে লেখার মানে নেই, তবে পেশাগত জীবন নিয়ে একান্ত নিজের কিছু উপলব্ধি শেয়ার করা যেতে পারে। 

আমার চেনা পরিচিত বলয়ের মানুষদের খুব কমই দেখেছি নিজের অফিস বা পেশা নিয়ে সন্তুষ্ট, বরং অফিসের প্রেশারে মাথা নষ্ট, বসের চোখ রাঙানি দেখে জীবন বরবাদ হয়ে যাওয়া মানুষই চারপাশে বেশি দেখি। কিছু মানুষের আসলেও হাত পা বাঁধা থাকে, চাইলেও তাই বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ সারাজীবন অদৃশ্য একটা শেকলে বাঁধা পড়ে থাকে- যেই শেকল কত নাজুক তা জীবনের শেষদিন পর্যন্তও অনেকে বুঝে উঠতে পারেনা। 

বছর দেড়েক আগে যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে আসি, তখন থেকে এখন পর্যন্ত শত শত বার মানুষের প্রশ্ন এবং হাইপোথিসিস টেস্টিঙের সামনে পড়তে হয়েছে। ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক উত্তর দিয়েছি যেগুলো সবই সত্য, (যদিও খুব কম লোকই তা বিশ্বাস করেছে!) কিন্তু সত্যিকারের কারণটা খুব কাছের মানুষ ছাড়া কাউকে বোঝাতে পারিনি, সেটা হল-
আমার ভাল লাগছিল না!

শিক্ষকতা আমার পছন্দের কাজ, যেই বিষয়ে পড়াতাম সেটাও প্যাশনের জায়গা। কিন্তু একটা সময়ের পরে মনে হচ্ছিল যেন ঠিক আমার নিজের  কাজ করা হচ্ছেনা! এই চিন্তাটা মাথায় সর্ষেবীজের মত ঢুকে একটা সময়ে ফুলেফেঁপে বিশাল হয়ে দাঁড়াল। শেষমেশ একসময় মনে হল- নাহ! ছেড়ে যাবার সময় হয়েছে! 

মাস শেষে বাড়িভাড়াটা আমাকেও দিতে হয়, প্রতিদিনের বাজারে আলুটা, মুলোটা এমনি এমনি পাওয়া যায় না, এসকল বাস্তবতার পরেও সবচেয়ে দামি যেই উপলব্ধি আমি এই জীবনে পেয়েছি তা হল- নিজের পছন্দের কাজ করেও আসলে বেঁচেবর্তে থাকা যায়! (এই উপলব্ধির কৃতিত্ব অনেকখানি আমার বস উন্মাদের সম্পাদক আহসান হাবীবের, আমার জীবনে ওনার ভূমিকা বলতে গেলে আস্ত উপন্যাস হয়ে যাব, কাজেই এখন সে প্রসঙ্গ থাক!) 

পেশাগত জীবনে আমাকে নিজের বিশ্বাস ও পছন্দের বাইরে গিয়ে কোন কাজ করতে হয়নি, ভাগ্য ভাল থাকলে বাকি জীবনও করতে হবে না আশা করি। সুখী মানুষ হতে আর কী লাগে?

আফসোস না থাক, কিছুই কি চাইবার নেই জীবনে? তা তো আছেই! ভাবতে গিয়ে প্রথমেই যেটা মনে হল- আহা, কতকিছু দেখা হয়নি পৃথিবীর! একে আসলে ঠিক আফসোস বলা চলে না। একজীবনে কতই বা দেখতে পারে মানুষ! তারপরেও বেঁচে থাকলে কী কী করা বাকি আছে তার একটা ছোট লিস্টি করলাম, করে বুঝলাম আলসেমি কমানো এখন সময়ের দাবি!

আপাতত লিস্টে যা যা আছে-
  • পৃথিবী ঘুরে দেখা, পৃথিবীর গল্প শোনা- এক জীবনে যতটা পারা যায়। সম্ভাব্য সব গন্তব্যের নাম লিখে ব্লগপোস্ট দীর্ঘ না করি।
  • ট্রেডিশনাল পেইন্টিং শেখা, এক্রিলিক প্রথম পছন্দ।
  • ক্যারিকেচারে আরো কতরকম এবস্ট্রাকশন করা যায় তা এক্সপ্লোর করা।
  • ছোটদের রূপকথা কয়েকটা মাথায় আর খাতায় আছে- সেগুলি লিখে এঁকে ফেলা। 
  • কোন একটা বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শেখা। (নিজের ধৈর্য্যের উপর ভরসা কম যদিও!)
  • নতুন ভাষা শেখা।
  • স্কুবা ডাইভিং শেখা। 
এসমস্ত কিছুই কাজের বাইরে অকাজের কথা। কিন্তু জীবনে শুধু কাজই করতে হবে এমন দিব্যি কে দিয়েছে?

একটা জীবন- পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ শুষে নেবার জন্য কতই না ক্ষুদ্র!