ক্লাস
সেভেনে রেজাল্ট বেশ খারাপ হয়েছিল, আগের সব বছরের চেয়ে খারাপ। তখন একটা ভয়ানক চল ছিল। এসএসসি আর এইচএসসিতে
স্ট্যান্ড করা, মেধাতালিকায় প্রথম দ্বিতীয় হওয়া কয়েকজনকে টিভিতে আনা হতো। চশমা পরা, বয়সের তুলনায় অস্বাভাবিক গম্ভীর
সেইসব ছেলেমেয়েরা তাদের সাফল্যের পেছনের পরিশ্রমের গল্প শুনাত; কেউ পড়ালেখা করেছে দিনে সতের ঘণ্টা, কেউ উনিশ। আমাদের মতো মাঝারি মানের
ছাত্রদের বাধ্যতামূলকভাবে সেই সব অনুষ্ঠান দেখতে হতো। উনিশ ঘণ্টা ক্লাসের বই পড়া? শুনেই দম আটকে আসত আমার; তাহলে গল্পের বই পড়ব কখন? আড্ডা মারব কখন? এইসব মুখ ফুটে বলা বিপজ্জনক, কাজেই চুপচাপ থাকতাম। এসব অনুষ্ঠান
দেখেও আচরণের আশানুরূপ পরিবর্তন না দেখায় মুরুব্বিরা গম্ভীর মুখে বলত,
“সময় আসুক, ঠিকই বুঝবা, তখন আফসোস করবা!”
সেভেনের
সেই রেজাল্টের পর সবার মুখ থমথমে। পারিবারিক আলোচনায় অসংখ্য উপদেশ, এই রেজাল্ট নিয়ে জীবনে কী ভয়াবহ
পরিণতি অপেক্ষা করছে তার রোমহর্ষক বর্ণনার পর সবশেষে সেই অমোঘ বাক্য “সময় আসুক, একদিন বুঝবা!”
মাঝারি
রেজাল্ট করে স্কুল কলেজ পাশ করলাম, মেডিক্যাল বুয়েট না হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উৎরে গেলাম। সেভেনের সেই
রেজাল্ট আমার নিজেরই আর মনে রইল না। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে রেজাল্টের লক্ষণীয়
উন্নতি হওয়ায় কিছুদিন পর সেই আপ্তবাক্য পড়ালেখা ছেড়ে অন্যদিকে ঘুরে গেলো।
“রান্নাবান্না কিছুই শেখ নাই? ঘরের কাজও তো পারো না। জীবন চলবে কেমনে? এখন তো বুঝতেস না; সময় আসুক, একদিন বুঝবা!”
সেই
একদিনের আশঙ্কা বুকে নিয়েই পড়ালেখা শেষ করলাম। আঁকাআঁকি করি, উন্মাদে যাই, নিউ এইজে কার্টুন আঁকি। সবার মুখে
হাসি ফুটিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করলাম। সামাজিক বিচারে এলিট
শ্রেণিতে নাম লেখালাম, ভাবলাম এবার মুক্তি! কিন্তু না!
“এখনো বিয়ে করো নাই? বয়স তো চলে যায়! আজকালকার মেয়েরা ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটতে ছুটতে সংসার ভুলে
যায়। সময় আসুক, একদিন বুঝবা কতবড় ভুল করতেস!”
রাজশাহীতে
একার সংসার। ক্লাসে মহা উৎসাহে ছাত্র পড়াই, নিজের ঘরে বসে কার্টুন আঁকি; সপ্তাহান্তে ঢাকায় এসে বাসায় সময়
কাটাই, উন্মাদে
গিয়ে আড্ডা দিই; নিরুদ্বেগ জীবন! এদিকে চারপাশ থেকে একটাই কথা, “একদিন বুঝবা!” চেনা, অচেনা, আধচেনা মানুষজন বিয়ের প্রস্তাব
নিয়ে হাজির হয়ে যাচ্ছে, সবারই দেখছি পরিচিত কোনো না কোনো ‘এলিজিবল ব্যাচেলর’ আছে।
এই
যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে এমনটা নয়; বরং নিজের পছন্দেই একসময় বিয়ে করে ফেললাম, সামাজিক বিচারে সামান্য ‘বেশি বয়সে’ যদিও।
ভাবলাম, এবার তো আর
চিন্তা নাই, প্রপার সামাজিক জীবন!
কিন্তু
না, ছয় মাস না
যেতেই নতুন পেরেশানি, “বাচ্চা নেবে কবে?”
প্রথম
প্রথম দুইজন এই প্রশ্ন হাসিমুখে এড়িয়ে যাই, তারপর থেকে যারা বলে তাদেরকেই এড়াতে শুরু করি; কিন্তু আলোচনা থামে না। বয়স বেড়ে
যাচ্ছে, মেয়েদের
বাচ্চা মানুষ করাই আসল কাজ, মা হওয়াটাই আসল ক্যারিয়ার, ইত্যাদি ইত্যাদি বহু বাক্যের পর আসে সেই অমোঘ বাক্য, “সময় আসুক, একদিন বুঝবা!”
এই বাক্য
এক কান দিয়ে শুনতে শুনতে এতদিনে আরেক কান দিয়ে বের করাও শিখে গেছি। এদিকে সময় গড়ায়, আমরা আমাদের দুই শহরে পেতে রাখা ভ্রাম্যমান
সংসারে অভ্যস্ত হয়ে উঠি। তবে কথায় আছে সুখে থাকলে মানুষ ভুতের কিল খায়; আমি খেলাম ব্রহ্মদত্যির কিল!
পরিবার-পরিজন-শুভানুধ্যায়ী সবার হৃদয় ভেঙে দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি
ছেড়ে দিয়ে স্বাধীন পেশায় ফিরলাম। নিজের মতো কাজ বাছি, কাজ করি, ইনকাম যা হয় তাতে আমার ভালভাবেই
চলে যায়। সময়ে অসময়ে নানা জনের আফসোস,
“এমন চাকরি কেউ ছাড়ে? বয়স কম তো, তাই বুঝতেস না। সময় আসুক, একদিন বুঝবা!”
এদিকে
বাচ্চা নেয়া বিষয়ক প্রশ্নবাণও থেমে নেই। এভাবেই বেশ কিছু বছর কাটে, একসময় আমরা সত্যি সত্যি পরিবারে
নতুন সদস্য আনতে আগ্রহী হই। তার দেড় বছরের মাথায় আমাদের ঘর থেকে একজন অতিদুরন্ত
কন্যাশিশুর গলা শুনতে পাওয়া যায়।
পড়ালেখা-ক্যারিয়ার-বিয়ে-বাচ্চা
সব তো হলো, ভাবলাম
আমাদের নিয়ে লোকের আফসোসের কাল তবে শেষ হল! দুইজন মহাসুখে বাচ্চা পালি, ঘরের-বাইরের কাজকর্ম করি; মোটামুটি নির্বিঘ্ন জীবন।
অনু, মানে আমাদের মেয়ের বয়স আট মাস হলো।
সদ্য সলিড খাবার শুরু করেছে, বিভিন্ন খাবারের স্বাদের সাথে পরিচিত হচ্ছে, আমাদের খাবার টেবিলে ছোট ছোট থালাবাটির সংযোজন
ঘটছে। সে যা খায়, তার চেয়ে বেশি মাখে, আমরা দুইজন সেই দৃশ্য মুগ্ধ হয়ে দেখি। যখন আমাদের অবাক করে অতিদ্রুত সে
কিছু শিখে ফেলে, আমরা আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই। মেয়ের জন্মের পর আমাদের ফোন এবং টিভির ব্যবহার
আগের চেয়েও কমে গেছে, বাচ্চার স্ক্রিনে আসক্তি যাতে না হয় তার শুরু হিসেবে নিজেদের আসক্তি কমানোর
চেষ্টায় আছি দুইজনেই। সেদিন এক দাওয়াতে গেলাম, সেখানে বিভিন্ন বয়সী বাচ্চাকাচ্চা, এবং বিভিন্ন বয়সী বাবা-মা। বছর
তিনেকের এক পিচ্চিকে খাওয়ানোর জন্য এক মা প্লেটে খাবার মেখে বসেছে। এদেশের খুব
সাধারণ দৃশ্য, ভদ্রমহিলা নিজের স্মার্টফোনে কিছু একটা চালু করে পিচ্চির হাতে দিল; পিচ্চি সম্মোহিতের মত সেই জিনিস
দেখতে দেখতে হাঁ করছে, আর তার মা সেখানে খাবার পুরে দিচ্ছে। আমাদের চেহারায় জাজমেন্টাল ভাব যাতে
ফুটে না ওঠে সেজন্য আমরা অন্যদিকে তাকিয়ে খেয়ে নিচ্ছি। একসময় উনি নিজেই বলে ওঠেন,
“ভাবী, বাচ্চাকে ফোন দেন না? খাওয়ান কীভাবে?”
“ফোন দেই না আপা, এমনিতেই খায়।”
“তাহলে কি টিভি দেখতে দেখতে খায়?”
“না আপা, ও নিজের ইচ্ছাতেই খায়। আর খেতে না চাইলে জোর করে খাওয়াই না।”
ভদ্রমহিলা
চোখ কপালে তুলে তাকালেন, উত্তর খুঁজছেন। অনুর দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন। তারপর হাসিমুখে
তাকিয়ে বললেন,
“ওহ! আপনার বাচ্চা তো ছোট! বড় হলে ঠিকই সামনে ফোন দেয়া লাগবে! না দিলে খাবেই
না!”
আমরা
একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করলাম, ফোন সামনে নিয়ে খাওয়ানোর অভ্যেস আমরা না করালে
এই অভ্যেস নিজে নিজে কীভাবে হবে? ভদ্রমহিলা আমাদের প্রশ্নকে উড়িয়ে দিয়ে ছাড়লেন সেই ব্রহ্মাস্ত্র!
“নিজেদের সময় আসুক, একদিন ঠিকই বুঝবেন!”
আপাতত
আমরা সেই ‘একদিনের’ অপেক্ষায় আছি।
সম্ভবত বাকি জীবন এই অপেক্ষাতেই কাটবে।
No comments:
Post a Comment