তো সেই অলকানন্দা ফুল একধাক্কায় নিয়ে গেলো ছোটবেলায়, ময়মনসিংহের যে গেস্ট হাউজে আমরা থাকতাম তার দোতলার টেরেসে ছিল এই অলোকানন্দার বিশাল ঝাড়। এত সুন্দর ফুল কিন্তু তেমন সুঘ্রাণ নেই, কেমন ঘাস ঘাস ঘ্রাণ, খুব অবাক লাগত। এই ফুলের পাপড়ি গুটিয়ে খুব জোরে হাতের তেলোয় মারলে পটকা ফোটার মত শব্দ হয়, আম্মু শিখিয়েছিল এই খেলা। সরকারি অফিসের চৌহদ্দিতে, অতি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বড় হবার কারণে পটকা, তারাবাতির মত দোষণীয় দ্রব্য কোনোকালেই আমাদের নাগালে ছিল না, তাই অলকানন্দার এই পটকা ফোটার শব্দেই আমাদের খুব আনন্দ হতো। এই ফুলের পাশেই ছিল নীলচে বেগুনি রঙের, ঘণ্টা আকৃতির অতি সুদৃশ্য আরেক জাতের ফুলের ঝাড়, পরে জেনেছি এর নাম নীল পারুল। আম্মু আগেই সতর্ক করেছিল, এই ফুল নিয়ে খেললে ভালো করে হাত ধুয়ে ফেলতে; কিন্তু সে কি আর মনে থাকে? ফলস্বরূপ, অসাবধানে হাত গেলো মুখে, আর বিচ্ছিরি তেতো স্বাদ মনে হয় যেন নাকে মুখে ছড়িয়ে গেলো। এত সুন্দর ফুলের এই রকম স্বাদ, কী অবাক কান্ড!
ভাগ্যিস এটাই আমাদের একমাত্র খেলা ছিল না।
শিশু বয়সে খুব প্রচলিত যেসব খেলা, যেমন বউছি বা ডাংগুলি খেলার সাথে আমাদের তেমন পরিচয় ছিল না। দলে বলে খেলার সুযোগ শুধু স্কুলের টিফিন পিরিয়ডের অল্প সময়টুকু, বরফপানি বা ওপেন্টি বায়স্কোপের জন্যেও সেটা বড় অল্প সময়। বাসায় ফেরার পর আমরা বড় দুইবোনই পরস্পরের একমাত্র খেলার সঙ্গী, সবচে ছোটটার তখনও জন্ম হয়নি, আরেক বোন তখনও মাটির সাথে কথা বলে। এখন যেই সময়ের কথা বলছি সেটা অবশ্য স্কুলে ভর্তি হবারও আগের। ঐসময় যেহেতু অন্য সংগীসাথি নেই, দুইজন মিলে বিচিত্র সব খেলা উদ্ভাবন করাই ছিল আমাদের কাজ। অবশ্য ভুল বললাম, আমাদের খেলার একজন দুর্দান্ত সঙ্গী ছিল, আম্মু। ফেলনা কাপড় পেঁচিয়ে পুতুল বানানোর আইডিয়া দেয়া থেকে শুরু করে রান্নাবাটী খেলায় মেহমান হয়ে এসে রান্নার প্রশংসা করা, কোনোকিছুতেই তার আগ্রহের কমতি ছিল না।
অবশ্য খেলার চেয়েও বেশি আম্মুর আগ্রহ ছিল ক্রাফটিংয়ে। সেই সুবাদে আমাদের খেলায় দারুণ সব অনুষঙ্গ যোগ হতো। যেমন, রান্নাবাটি খেলা তো সব বাচ্চারাই খেলে, আমাদের ক্ষেত্রে এই খেলা ছিল improvised। আমাদের ছোট ছোট হাঁড়িপাতিলের সাথে ছোট্ট একটা ফ্রিজও ছিল! পুরোনো প্যাকিং বাক্সের শোলা কেটে কুটে আম্মু বানিয়ে দিয়েছিল এই ফ্রিজ, তাতে পাল্লা ছিল, শেলফ পর্যন্ত ছিল। আমরা খেলা শেষে সিরিয়াস মুখে 'left over' গুলো ফ্রিজে তুলে রাখতাম!
আর ছিল আমাদের টিভি। ম্যাচের বা সিগারেটের বাক্সের সামনের দিকে চৌকোনা করে কেটে বানানো হতো স্ক্রিন, ভেতরে হাতে আঁকা ছবি বায়স্কোপের মত সেট করে কাঠি দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখা যেতো।
আম্মুর থেকে ক্র্যাফটিংয়ের শখ আমাদের দুইবোনের মধ্যেই সংক্রমিত হয়েছিল। একবার খুব মাটির জিনিস বানানোর হিড়িক পড়ল আমাদের। অফিস ও আমাদের বাসার বাগান দেখাশোনার জন্য ছিলেন গণি কাকা, কুচকুচে কালো কষ্টিপাথরের মত রং, পেটা শরীর, আর মুখভর্তি হাসি নিয়ে আমাদের নানা আবদার মেটাতেন তিনি। আব্বুকে যেগুলো বলার সাহস নেই, সেসব শখ মেটানোর জন্য গণি কাকা, মোতালেব কাকা, আইনদ্দি কাকা ছিলেন এক পায়ে খাড়া। আমরা মাটির জিনিস বানালে ভেঙে ভেঙে পড়ে, তাই দেখে গণি কাকা অফিসের পুকুরের নিচ থেকে এনে দিলেন আঠালো এঁটেল মাটি। সেই মাটি দিয়ে বানানো হলো নৌকা, ঘর, টেপা পুতুল। বানানো শেষে একেকটা শিল্পকর্ম আম্মুকে দেখানো হতো, সেখানে সবসময়ই কিছু ফিডব্যাক পাওয়া যেতো। আম্মু কখনোই অকারণ প্রশংসায় ভাসিয়ে দিত না, কাজেই তার মতামত আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আস্তে আস্তে শিখলাম, মাটির সাথে খড় কুচি মিশিয়ে দিলে টেকসই হয় বেশি।
মাটির জিনিস বানানোর থেকে সহজ ছিল কাগজের ক্র্যাফটিং; কাগজের ফুল, কিংবা ঈদের আগে বা নববর্ষের সময় আর্ট পেপার কেটে বানানো কার্ড। সরকারি বাসার বিশাল ড্রয়িংরুম ছিল আমাদের কাজের ওয়ার্কশপ, ব্যাকগ্রাউন্ডে হেমন্ত উদাত্ত কণ্ঠে গেয়ে চলতেন, "ধিতাং ধিতাং বোলে, কে মাদলে তান তোলে, কার আনন্দ উচ্ছ্বলে আকাশ ভরে জোছনায়..."।
অঞ্জন তখনও তার পুরোনো গিটার বাজিয়ে আমাদের আকুল করেন নি; কবীর সুমন তখনো চ্যাটার্জি, গানওয়ালা নিয়ে হাজির হন নি আমাদের ড্রয়িংরুমে। কাজেই আমাদের শৈশব তখন পর্যন্ত হেমন্তের কণ্ঠে আর সলিল চৌধুরীর সুরেই বলতে গেলে বাঁধা ছিল, আর মাঝে মাঝে ছিল শ্যামল মিত্র, সাগর সেন, সুচিত্রা মিত্রদের যাওয়া আসা।
বলাই বাহুল্য, শৈশবের এসকল সুর আম্মুর থেকেই পাওয়া।
রঙের সাথে ঘ্রাণের এসোসিয়েশনের কথায় ফিরে যাই। একবার খুব আয়োজন করে বাসা রং করা হলো, চুনকামের ঘ্রাণে বাতাস ভারি। সেই থেকে হলদে সাদা রংটা কিভাবে যেনো এই চুনকামের ঘ্রাণের মধ্যে আটকে গেলো। এখনও কোথাও এই রং দেখলেই নাকে এই ঘ্রাণ ধাক্কা দেয়। তবে ধবধবে সাদা রংটা সবসময় বেলি আর গন্ধরাজের জন্য বাঁধা, সাদা মানেই বর্ষাকাল, গন্ধরাজ বা বেলির পাঁপড়ির ওপর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। সাদা রঙের সাথে বর্ষার ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণটাই ছিল আজীবনের এসোসিয়েশন।
তবে সেটা দুবছর আগে সব ওলটপালট হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত।
সাদা ছিল বেলি আর গন্ধরাজের ঘ্রাণ। এখন সাদা রং মানে শুধুই আইসিইউ, হাসপাতাল, আর বিষণ্ন মৃত্যুর ঘ্রাণ।
আমাদের সব সুর, রং, ঘ্রাণ বুকে নিয়ে একটা মানুষ চলে গেছে। আজ তার জন্মদিন।
শুভ জন্মদিন আম্মু!
No comments:
Post a Comment