Friday, July 19, 2024
Tuesday, October 31, 2023
হাসনাহেনার ঝাড় (পর্ব: শিউলী ফুলের ঘ্রাণ)
তিন দশকেরও বেশি আগে আম্মুর করা এম্ব্রয়ডারি, সেই শিউলি মালা |
২০১৩ সালে করা কুইক স্কেচ... যখন চাইলেই সামনে বসে আম্মুকে আঁকা যেত |
Wednesday, April 12, 2023
Friday, April 07, 2023
হাসনাহেনার ঝাড় (পর্ব: প্রথম ইশকুল)
আমার জীবনে শেখা প্রথম কঠিন বানান হলো ENGINEER।
বাপ রে, কত্তগুলো অক্ষর! বানানের সাথে উচ্চারণের মিল থাকলেও না হয় মনে রাখা যেত! তাও না। ইঞ্জিনিয়ার যদি হয় উচ্চারণ, তবে বানানটা হবার কথা INJINIAR। এমন আজব কেনো বানানের নিয়ম তা আমার ছোট মাথায় ঢুকতই না।
EN-GI-NEER, আম্মু এভাবে ভেঙে ভেঙে শেখাত। বড় শব্দকে তিন টুকরা করে, ভাত খাওয়ানোর সময় বড় লোকমাকে ছোট ছোট করে পায়রার ডিম, মুরগির ডিম বানিয়ে যেভাবে খাওয়াত, অনেকটা সেভাবে। তো ঐ বয়সে এই শব্দ শেখার দরকার কেনো পড়ল? ওই যে- স্কুলে ইংরেজি ক্লাসে যখন নিজের সম্পর্কে লিখতে হতো, ‘My father is an engineer, my mother is a housewife…’। তখন মনে হতো, আব্বু ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে সহজ কিছু কেনো হলো না- এই যেমন Farmer, Doctor, এরকম কিছু। এক বন্ধুর বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী, তাকে ‘My father is a businessman’ লিখতে দেখে আমার রীতিমত মায়াই লেগেছিল!
এইটুকু পড়ে মনে হতে পারে, কঠিন কঠিন শব্দে অনেক ভীতি ছিল আমার। কথাটা আংশিক সত্যি। ইংরেজি গল্পের বই আম্মু টুকটাক পড়ে শোনাতো বটে, কিন্তু কঠিন শব্দ বানান বুঝে পড়া তখনো শিখিনি। বাংলা বরং অনেক সোজা, গল্প আর ছড়ায় কঠিন কঠিন শব্দগুলোও কী সুন্দর ঠিক ঠিক এঁটে যায়! আম্মু আমাদের দুই বোনকে কোলের উপর বসিয়ে যখন ‘পুরাতন ভৃত্য’ বা ‘দুই বিঘা জমি’ আবৃত্তি করে শোনাতো, মোটেও কঠিন মনে হতো না লাইনগুলো। তবে এগুলো বড় দুঃখের কবিতা। আমার বেশি প্রিয় ছিল ‘খাঁদু দাদু’ আর ‘লিচু চোর’।
দুঃখের কবিতাগুলো আমার কাছে মনে হতো যেন ঠিকমত শেষ হয়নি, যেন আরো কিছু ঘটার কথা ছিল। ‘পুরাতন ভৃত্য’ পড়ে একেবারে মুষড়ে গেছিলাম, কেষ্টা যে একেবারে মরেই গেল! মরে যাবার পরে যে আর কিছু ঘটবার থাকে না তা বোঝার বয়স তখনই হয়েছিল।
তবে আম্মু বোধ হয় তার বছর পাঁচেকের কন্যার মন খারাপটা দেখতে চায়নি। তাই আমাদের পড়ে শোনানোর সময় কবিতার শেষটুকু প্রায়ই বদলে যেত। ‘দুই বিঘা জমি’ তে জমিদারবাবু উপেনের জমি কীভাবে ‘ডিক্রি’ জারি করে হাতিয়ে নিল তা আমি মেনেই নিতে পারতাম না। বলতে গেলে বাধ্য হয়েই, আম্মু কবিতার শেষটা সামান্য পাল্টে দিলো। তাই আমার ছোটবেলার স্মৃতিতে ‘দুই বিঘা জমি’তে পুরোদস্তুর হ্যাপি এন্ডিং, কবিতার শেষ লাইন আর উপেনের মুখে রইলো না। বরং শেষ দৃশ্যে বাবু নিজেই তার ভুল বুঝতে পেরে উপেনের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছে,
‘তুমি মহারাজ, সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।’
পরপারে বসে রবি ঠাকুর নিশ্চয়ই আম্মুর এই নিদারুণ অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন!
রবীন্দ্র-নজরুলের সাথে আম্মুর এই সখ্যতার কারণে আমাদের ভাণ্ডারে শব্দের কমতি ছিল না। একবার থ্রি-ফোরে থাকতে একটা কঠিন বাংলা শব্দ শেখা হলো- ‘পৃষ্ঠ-পো-ষ-ক-তা’, কোন বই থেকে পড়েছিলাম এখন আর মনে নেই। তবে বেশ পছন্দ হলো শব্দটা, মুর্ধন্য-ষ, ঠ, ক, ত মিলিয়ে বেশ একটা এলাহি অবস্থা, লিখতে গেলেই নিজের মধ্যে বেশ জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব চলে আসে। প্রথম সুযোগেই এই শব্দ চালিয়ে দিয়েছিলাম বাংলা পরীক্ষার খাতায়, বাংলা শিক্ষকের অবাক করা চেহারা দেখে বেশ একটা গর্বও হয়েছিল মনে পড়ে। সেই গর্ব ভাঙতে বেশিদিন লাগে নি, তবে সে কথায় পরে আসি।
সত্যি বলতে, তখন পর্যন্ত স্কুল আমার বেশ ভালই লাগত। আসলে স্কুল যে একটা টর্চার সেল, সেটা বুঝেছি বেশ কবছর স্কুলে যাবার পর। এটার বড় কারণ খুব সম্ভবত প্রথম স্কুলের অভিজ্ঞতা। প্রথম স্কুল বলতে আমাদের কাছে যা ছিল তা হলো সন্ধ্যাবেলায় আম্মুর কাছে পড়তে বসা। তবে সে স্কুলেও কায়দা কানুনের অভাব ছিল না। সিরামিক আর মেলামাইনের ভরভরন্ত কালের আগে মধ্যবিত্ত বাসাবাড়িতে খাওয়া হতো স্টিলের প্লেটে। সেই স্টিলের প্লেট আর ভাতের চামচ হতো আমাদের স্কুলের ঘণ্টা। আমরা দুই বোন গম্ভীর মুখে ব্যাগে বইপত্র নিয়ে রেডি হয়ে পাশের ঘরে অপেক্ষা করতাম, আর ঘণ্টা পড়লেই আমাদের ছোট্ট পড়ার টেবিলে এসে বসতাম। আম্মু হতো ক্লাস টিচার, আর টিফিনে থাকত বাসায় বানানো হালকা পাতলা নাশতা। এই স্কুলের বইপত্র ছিলো বিচিত্র। কলকাতায় ছাপা বিমল দাসের আঁকা ছবির সাথে ছড়া আর গল্পের বই থাকতই, আর থাকত এপার-ওপার বাংলা মিলে নানা জাতের বাংলা বর্ণ আর শব্দ শেখার বই, তবে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় ছিল টোনাটুনির ক্যাসেট। মজিবুর রহমান দিলু, যাকে আমরা সংশপ্তকের ‘মালু’ নামেই চিনতাম, তার ভরাট গলায় যখন বেজে উঠত ‘এবার ক্যাসেটটা উল্টিয়ে দিয়ে শোনো…’, আমাদের দুই বোনের কাড়াকাড়ি লেগে যেত কে আগে গিয়ে ক্যাসেট ওল্টাবে।
(চলবে)
Tuesday, November 22, 2022
হাসনাহেনার ঝাড় (ভূমিকা পর্ব)
“You want to know so much about his death, but what do you know about his life?”
~ Loving Vincent
আম্মু চলে যাবার আজকে ২২তম দিন। জীবনের কঠিনতম তিনটি সপ্তাহ আইসিইউর সামনে কাটানোর পর গত এই কটি দিন কীভাবে গিয়েছে আমরা কেউই জানিনা। হাসপাতালের পুরো সময় শুভাকাঙ্খিরা সমবেদনা জানিয়েছেন, খোঁজ নিয়েছেন। আত্মীয়-অনাত্মীয়রা অপ্রত্যাশিত ভালবাসা যেমন দেখিয়েছেন, পাশেও দাঁড়িয়েছেন সকল প্রয়োজনে।
তারপর এক বিষণ্ণ ভোরে আমাদের সব প্রয়োজন ফুরালো, আমাদের আটকে থাকা নিঃশ্বাসটা দীর্ঘশ্বাস হয়ে ঠিকানা হারালো। এমন ঘটনায় কাছের-দূরের সকলে দুঃখিত হয়, সমব্যাথী হতে চায়। জানতে চায়- কী হয়েছিল? কীভাবে এমন হলো? আর কি কিছু করার ছিল না?... সংক্ষেপে উত্তর দিই। কিন্তু উত্তরের পিঠে চেপে আসে আরো বহু প্রশ্ন- সার্জারি, ভেন্টিলেশন, আইসিইউ... পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম শব্দগুলো সুঁচের মত গেঁথে গেঁথে বসে বুকে পিঠে। দ্রুত কথা সেরে প্রসঙ্গ পাল্টাই। পরদিন আবার, অন্য কেউ, অন্য কোথাও, একরাশ দুঃখ নিয়ে জানতে চায়- কী করে হলো?...
হঠাৎ আবিষ্কার করি, মানুষ আসলে জীবনের চেয়ে মৃত্যু নিয়ে বেশি কৌতূহলী। অথচ মৃত্যু কি আশ্চর্য নির্বিকার একটা ঘটনা, যেখানে এসে সব মানুষ মিলে মিশে এক হয়ে যায়। ঠিক যেমন কবরস্থানের সারি বেঁধে শুয়ে থাকা মানুষগুলোকে দেখতে হুবহু একই মনে হয়। মৃত্যুর আয়োজনটাও তো একইরকম নির্বিকার- যেকারণে আইসিইউতে সারি সারি বেডে শুয়ে থাকা মানুষগুলোকে হঠাৎ করে দেখলে আশ্চর্যজনকভাবে একইরকম দেখায়! অথচ এই নৈব্যক্তিক বিষয়াদি দিয়েই আমরা জানতে চাই, চিনতে চাই, সংজ্ঞায়িত করতে চাই মানুষকে। এ কী ভীষণ অন্যায়!
প্রতিটি মানুষ যদি অনেকগুলো গল্পের সমষ্টি হয়, তবে সেই গল্পগুলোই তো তার সত্ত্বা, তাকে চেনার, জানার, ছুঁয়ে দেখার উপায়। আম্মুর গল্পগুলো তাই আমি খুব করে বলতে চাই। মনে না থাকা শৈশবে, যেই স্মৃতি বা বিস্মৃতিতে শিউলী ফুলের ঘ্রাণকে কিছুতেই আমি আম্মুর শাড়ির ঘ্রাণ থেকে আলাদা করতে পারিনা; সেই ভুলে যাবার কালে- যেসময়ের টুকরো স্মৃতিতে হঠাৎ হঠাৎ আম্মুর হাসির পাশে উঁকি দেয় বারান্দায় ফোটা সূর্যমুখী ফুল; সেই সময়ের ঘ্রাণ আমি টুকে রাখতে চাই। এই গল্পগুলো বলার আয়োজন হয়ত বড় বেশি ব্যক্তিগত, তাতে কী?
এই যাহ, বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম।
শুভ জন্মদিন আম্মু!
নভেম্বর ২২, ২০২২
Sunday, February 20, 2022
নতুন শিক্ষাক্রম রূপরেখা: বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব কী কমে যাচ্ছে?
এই লেখাটা গত ২৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ সারাবাংলা ডট নেটে প্রকাশিত হয়। আগেই বলে রাখা ভাল, গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে যে কাজ নিয়ে নাক পর্যন্ত ডুবে আছি তা হল প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণির অবিচ্ছিন্ন শিক্ষাক্রম রূপরেখা, এবং তার আলোকে নতুন শিক্ষাক্রম ও বই পুস্তক তৈরি। শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আমরা চুন খেয়ে মুখ পোড়ানো জাতি, কাজেই যেকোন নতুন উদ্যোগ নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা হবার কথা, সেটাই হচ্ছিল এবং এখনো হচ্ছে! নতুন রূপরেখায় বেশ বড় বড় কয়েকটি পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে- তার মধ্যে একটা হল নবম-দশম শ্রেণিতে সায়েন্স, আর্টস, কমার্স বিভাগ না রেখে সবার জন্য অভিন্ন বিষয়ের ব্যবস্থা। এই বিষয়টা নিয়ে চারপাশে বহু আলোচনা শুনেছি, পক্ষে বিপক্ষে নানা যুক্তি দেখেছি। এই বিশাল কর্মযজ্ঞের শুরু থেকেই এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকার সুবাদে বিষয়টা নিয়ে কিছু কথা বলার দরকার মনে হল, তাই এই লেখা। গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হলেও আজ মনে হল, নিজের ব্লগেও লেখাটা টুকে রাখা দরকার-
Thursday, December 31, 2020
বিদায় বিষাদের বিশ!
সেই বিকেলের পর থেকে আমি বোধহয় জীবনে একটা দিনও শতভাগ খারাপ ভাবে পার করি নি। কিন্তু অর্থহীন জীবনের ততোধিক অর্থহীন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখে হয়ত অনেক সময় সন্ধ্যার আকাশের রঙ পালটানো দেখতে ভুলে গিয়েছি, হয়ত শরতের অনেক কাশফুলের কণা ছুঁতে এসে অপ্রস্তুত হয়ে ফিরে গেছে। এভাবেও জীবনটা খারাপ কাটছিল তা নয়, কিন্তু হেমন্তের আকাশে কালপুরুষকে একটু অপেক্ষা করতে বলে আমি যে সেকথা বেলামুল ভুলে গিয়েছিলাম তার দায় কে নেবে? ব্যস্ত ছিলাম, তবে দিনগুলো কাটছিল মন্দ নয়, কিন্তু সব তালগোল পাকিয়ে দিল এই দুহাজার বিশ। কাঁধ ধরে শক্ত ঝাঁকুনি দিয়ে বলল- ওঠ ওঠ, বেলা যে বয়ে যায়! জীবন হাত খুলে যা মণিমাণিক্য ছড়িয়ে দিল, তা কুড়িয়ে নেয়া হল কই?
বিষাদের এই দুহাজার বিশ কেড়ে নিয়েছে অনেকের অনেক প্রিয়জনকে, অনেকের বেঁচে থাকাকে করেছে মৃত্যুর চেয়েও কঠিন। সেদিক দিয়ে দেখলে নিজেকে সৌভাগ্যবান বলতেই হয়- কোভিড নামক বিচ্ছিরি অসুখটা আমার জীবন থেকে দুমাস সময় চেয়ে নিয়েছে বড়জোর। কিন্তু সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকার যেই অভিনয়, সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে একটা বিষম টিটকারিও দিয়ে গেছে বলতেই হয়!
সাথে এ-ও মনে করিয়ে দিয়েছে- কতদিন শুক্লপক্ষের চাঁদের আলোয় মেঘেদের সভা দেখা হয়নি!
Thursday, July 30, 2020
একটি বড়োদের রূপকথা
বড়োদের রূপকথা হয় নাকি আবার? হয় তো! কিন্তু রূপকথা তো বড়োদের ঢঙে লিখবার নিয়ম নেই। তাহলে আমরা ছোটদের মত করেই একটা বড়োদের রূপকথা বলার চেষ্টা করি না হয়!
অনেক অনেক কাল আগের কথা, এক দেশে ছিল এক রাজা আর কয়েক রাণী। সেকালে রাজাদের কয়েকজন করে রাণী থাকাই ছিল দস্তুর। রাজার ছেলে হত সিংহাসনের উত্তরাধিকারী, সেই উত্তরাধিকার নিয়ে রাজপুত্রদের ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া হত, খুনোখুনি হত, আরো কত কী! ইলেকশন নেই, ভোটাভুটির বালাই নেই- বেশ সোজাসাপ্টাই ছিল এই রাজা হবার বিষয়টা। ওহ হো, রাজকন্যাদের কথা তো বলাই হয়নি! রাজকন্যাদের বিয়ে হত দূর দূর দেশের রাজপুত্রদের সাথে, তাতে সেই দূরদেশের সাথে রাজ্যের একটা সম্পর্কও তৈরি হত। রাজ্যে রাজ্যে বিরোধ হত, যুদ্ধ হত, তখন এসব বন্ধু দেশের সাহায্যের দরকার পড়ত।
তো সেকালে রাজারাজড়া ছাড়াও দেশে ছিল আমজনতা- সেযুগে তাদের বলা হত রাজার প্রজা। এই প্রজারা একরকম রাজাদের সম্পত্তিই ছিল বলা চলে। তারা সারাবছর খাটাখাটনি করে পেট চালাত, সময়মত রাজাকে খাজনা দিত। কপাল ভাল হলে রাজারা হতেন ভালমানুষ টাইপের, প্রজাদের খাজনা পেয়েই খুশি থাকতেন। আর কপাল খারাপ হলে রাজা হতেন অত্যাচারী, যাকে যখন খুশি শূলে চড়াতেন, মেরে ধরে দেশ শাসন করতেন। সেকালে এই রাজাদের যুগে প্রজারা সুখে ছিল নাকি কষ্টে ছিল সে খবর ইতিহাসের বইয়ে পাওয়া যায় না। হয়ত তাদের ভাল থাকা না থাকা ততটা মাথা ঘামানোর ব্যাপারই ছিল না সেকালে।
আমাদের গল্পে ফিরে আসি বরং, যেদেশের কথা বলছি সেদেশের রাজা কেমন মানুষ প্রজারা ঠিক জানেনা। কী করে জানবে, কখনো চোখেও তো দেখেনি রাজা-রাণী-রাজপুত্রদের! রাজার পাইক পেয়াদারা সময়মত খাজনা নিয়ে যায়। রাজকোষে সব দিয়ে থুয়ে যা থাকে তা দিয়ে কেউ খেয়েপরে চলতে পারে, কেউ পারে না। সেবার খরার বছরে রাজার মেয়ের বিয়ে হল মহা ধুমধাম করে দক্ষিণের রাজ্যের মাঝবয়সী রাজার সাথে। বাড়তি খাজনা দিতে গিয়ে কিছু লোক না খেয়ে মরল ঠিক, কিন্তু সে বিয়েতে নাকি রাজ্যের বড় উপকার হয়েছিল; পশ্চিমের মারকুটে রাজারাও আমাদের রাজাকে সমীহ করে এখন!
তো, ভালই চলছিল সবকিছু। একদিন রাজ্যের বন্দরে এসে ঠেকল আনকোরা এক জাহাজ, ঝকঝকে তকতকে সে জাহাজ ভরা চমৎকার দেখতে সব যুবাপুরুষ, তাদের মাঝে স্বর্ণকেশী অনেক নারীও আছে। কিন্তু এই নারীপুরুষরা ঠিক এই রাজ্যের মানুষের মত নয়। তারা দেখতে বেশ শক্তপোক্ত ধরণের, চলন বলন এমন যে সমীহ না করে উপায় নেই। রাজ্যের বুড়োরা দূর থেকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখল, একটু সাহসী কমবয়সী তরুণরা গেল আরেকটু কাছাকাছি, শুধালো- কে গো তোমরা? তোমাদের রাজা কোথায়?
- রাজা নেই?’ চোখ কপালে উঠল প্রশ্নকর্তার। ‘তাহলে তোমাদের শাসন করে কে? দণ্ডমুণ্ডের বিধান দেয় কে? খাজনা নেয় কে?
- সে আমরা সবাই মিলেই ঠিক করি। ফি বছর সবাই মিলে আমাদের মধ্য থেকেই কয়জনকে নেতা ঠিক করে, তারাই সকল সিদ্ধান্ত নেয়। খাজনার টাকা কোথায় কী খরচ হবে তাও তারা ঠিক করে, বছর শেষে তার হিসেবও দেয়।
উল্কার বেগে এই নতুন দেশের খবর ছড়িয়ে গেল আমাদের এই ছোট্ট রাজ্যে। এমন আজব কথা কেউ কখনো শোনে নি- এমন রাজ্য যেখানে রাজা নেই, রাণী নেই, নেই রাজপাট। বুড়োরা নাক কুঁচকে বলল- এ আবার কেমন ছিষ্টিছাড়া দেশ! রাজরক্ত না থাকলে কাউকে মানবে কেন প্রজারা? আর রাজা ছাড়া প্রজার ভালমন্দ দেখবে নাকি কেউ? তরুণ যুবারা অবশ্য এসব কানে তুলল না, তারা বরং নতুন জাহাজের মানুষদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল অসীম কৌতূহল নিয়ে।
এক ঝলমলে সকালে নতুন জাহাজটা যেমন নোঙর ফেলেছিল, তেমনি এক সন্ধ্যায় গোলাপি আকাশকে পেছনে ফেলে জাহাজ আবার পাল তুলল। কিন্তু রেখে গেল শত শত প্রশ্ন, আর আনকোরা নতুন চিন্তা। তরুণরা গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসল- তাই তো! রাজার ছেলে বলেই কেউ রাজা হবে কেন? প্রজাদের পছন্দ অপছন্দের দাম কেন থাকবেনা?
বছর গড়ায়, খাজনার সময় ঘনিয়ে আসতে থাকে। বড় বড় চিন্তা বাদ দিয়ে রাজ্যের লোকে নিত্যকার কাজে নেমে পড়ে, অলস চিন্তার আর সময় কই? আস্তে আস্তে তাদের স্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে আসে সেই আজব জাহাজের কথা।
মানুষ প্রায় ভুলেই গেছিল, বছর কয় পর এক ভোরে বন্দর থেকে ছুটতে ছুটতে এল এক কিশোর। এসেছে! সেই স্বপ্নের দেশের জাহাজ আবার এসেছে! কাজ ফেলে লোকে ছুটল পুরনো অতিথিদের আবার দেখতে।
সবার চোখেই এইবার কিছু পরিবর্তন যেন ধরা পড়ল। জাহাজের জৌলুস যেন আগের চেয়ে একটু কম, কিন্তু মানুষের সংখ্যা যেন আগের চেয়ে বেশি, আর জাহাজটার আকারও যেন একটু বেড়েছে। এখনো হাসিখুশি তারা, কিন্তু কারোর কারোর ভুরুতে যেন একটু চিন্তার ছাপ, ঝলমলে আনন্দে যেন একটু ভাটা পড়েছে!
যথারীতি এবারও রাজ্যের প্রবীণরা রইলো দূরে দূরে। কিন্তু তরুণদের ভীষণ আগ্রহ এই আজব জাহাজের মানুষদের নিয়ে, তারা তাদের কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করল প্রথমদিনেই- দু’চারজন খাতিরও পাতালো কারো কারো সাথে। তাদের কাছ থেকেই জানা গেল সব ঘটনা-
এই জাহাজের সবই ছিল ঠিকঠাক, একেবারে নিখুঁত, পরিপাটি। কিন্তু এর ঝলমলে মানুষগুলো প্রায় ভুলেই গিয়েছিল জাহাজের খোলের মধ্যে বসে দাঁড় টানে যে মানুষগুলো তাদের কথা। কোন এক দিন জাহাজের সব দাঁড়ি একযোগে দাবি তুলল, জাহাজ চালাতে তাদেরও মতামত নিতে হবে। আর অন্যদের মত তাদেরও নানা সুযোগ সুবিধা দিতে হবে, এই গাধার খাটনি আর তাদের পোষাচ্ছে না! খুবই যৌক্তিক দাবি সন্দেহ নেই, কাজেই জাহাজের নিয়ম কানুন নতুন করে লেখা হল। জাহাজের খোলের ভেতর যারা কাজ করে তাদেরও মত নেয়া হবে সব বিষয়ে- এমনটাই ধার্য হল। এই পর্যন্ত তাও সব মোটামুটি ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু ইদানিং নতুন নতুন কিছু কথা শোনা যাচ্ছে, এদেরই কেউ কেউ নাকি রব তুলেছে তাদেরও জাহাজের বাকিদের মত রেশমের রুমাল চাই, আর চাই জড়িদার জুতো! কিন্তু ওদের এই কালিঝুলিমাখা কদাকুচ্ছিৎ চেহারায় এসব বাহারি জিনিস কি মানায়?- এই অদ্ভুত আবদার শুনে তাই জাহাজের ঝলমলে সুন্দর মানুষদের অনেকেই বেশ বিরক্ত, মনঃক্ষুণ্ণ।
খুব মুশকিলের ব্যাপার সন্দেহ নাই, রাজ্যে সবার মুখে মুখে এইসব ঘটনা ছড়িয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। বুড়োরা মুখ ভেংচে বলল- উপযুক্ত রাজার শাসনে না থাকলে এমনই হয়, যত্তসব বিশৃঙ্খলা! তরুণদের মধ্যে জাহাজের দাঁড়িদের পক্ষে বিপক্ষে সোজা দুই ভাগ হয়ে গেল- কিন্তু কেউই এই অদ্ভুত সমস্যার কোন সমাধান দিতে পারল না!
আমাদের ছোট্ট রাজ্যের মানুষদের একরাশ চিন্তা আর তর্কবিতর্কের মধ্যেখানে ফেলেই আবার এক সন্ধ্যায় পাল তুলল সেই বিদেশি জাহাজ। কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে রাজ্যের লোকের আলোচনা চলল আরো কিছুদিন। নিত্যকার কাজের ফাঁকে ফাঁকে তরুণরা ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে তর্ক করল সেই জাহাজের নিয়মকানুন নিয়ে। আরো কিছুদিন হয়তবা এই আলোচনা চলত- কিন্তু এর মাঝেই এল ভীষণ বন্যা। নদীনালার কূল ছাপিয়ে, লোকের ঘরদোর, ক্ষেতের ফসল সব ভাসিয়ে নিয়ে গেল বন্যার স্রোত। গোদের ওপর বিষফোঁড়া- এই বন্যার মাঝেই পশ্চিমের রাজ্যের সাথে কী একটা যুদ্ধও বেঁধে গেল বলতে গেলে হুট করেই। যুদ্ধের সৈনিকদের খাবার, অস্ত্রের ব্যবস্থা করতে বন্যার মধ্যেও খাজনা গেল বেড়ে। লোকের নাভিশ্বাস উঠে গেল খাজনা শোধ করতে, পেটের দায়ে দলে দলে তরুণরা যুদ্ধে যোগ দিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ফিরে এল, অনেকেই ফিরে এল না। যুদ্ধে হেরে রাজা দক্ষিণের রাজ্যে গিয়ে আশ্রয় নিল, এদিকে পশ্চিমের রাজা দখল করে নিল আমাদের এই ছোট্ট রাজ্য। যদিও এসমস্ত কিছুই লোকমুখে শোনা, প্রজারা আগের রাজাকেও কোনদিন চোখে দ্যাখেনি, কাজেই এই খবরেও তাদের কোন ভাবান্তর দেখা গেল না।
সবকিছুরই শেষ আছে, কাজেই একদিন আবার সব শান্ত হয়। যুদ্ধ শেষ হয়, বন্যার পর রাজ্যে নতুন ফসল ওঠে। বেঁচে থাকা মানুষেরা নতুন করে ঘর তোলে, সংসার পাতে। এত এত ঝুটঝামেলায় অন্য কিছু ভাবার সময় কই? জীবন আবার নিস্তরঙ্গভাবে বয়ে চলতে থাকে আমাদের গল্পের রাজ্যের মানুষদের।
বেশ অনেকদিন পর, দূর সমুদ্রের ওপর দেখা গেল একটা জাহাজের মাথা। এই বন্দরে জাহাজ আসে খুব কম, কাজেই উৎসুক চোখের অভাব হল না। কাছাকাছি আসতে অবাক বিস্ময়ে মানুষ চিনতে পারল, এই তো সেই বিদেশি জাহাজ; কিন্তু এ কী হাল হয়েছে এর? ঝকঝকে কাঠামো মলিন হয়ে পলেস্তারা খসে পড়ছে, মানুষের মধ্যে না আছে সেই জৌলুস, না আছে সেই ঝলমলে আনন্দ। কোন কথা জিজ্ঞেস করলে জবাব দেয় না- শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে দূর সমুদ্রের দিকে।
হাত খুলে আপ্যায়ণ করল রাজ্যের লোকেরা এই দিশেহারা মানুষদের। দুদিন ঝিম ধরে থাকার পর ধীরে ধীরে সব বলতে শুরু করল বিদেশি অতিথিরা-
জাহাজের ওপরতলার ঝলমলে সুন্দর মানুষদের সাথে খোলের ভেতরে থাকা দাঁড়ি, খালাসিদের পার্থক্যটা দিনকে দিন বিচ্ছিরিভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। সমান মতামত দেবার অধিকার পাবার পর আস্তে আস্তে অন্য বিষয়গুলোও সামনে চলে আসতে শুরু করে। রেশমি রুমাল, জড়িদার জুতোর চাহিদাই শুধু নয়, খোলের ভেতরে অন্ধকারে যেখানটায় তাদের খাবার, ঘুমোবার জায়গা- তা নিয়েও আপত্তি তুলতে থাকে তারা। ওপরতলার কিছু মানুষ গোড়া থেকেই এসব ঠিক মেনে নিতে পারেনি। সমস্যা ভীষণ গুরুতর হয়ে উঠল যখন খোলের ভেতর থেকে দাবি উঠল, সবাইকেই সব কাজ করতে হবে! সবার খাওয়া-পরার বরাদ্দ যদি সমান হয়, তাহলে কাজই বা কয়েকজন বেশি করবে কেন? সবাইকেই নিয়ম করে দাঁড় টানতে হবে। যুক্তি এতই অকাট্য যে সবাই মেনেও নিল। নাহ, আসলে সবাই মেনে নেয়নি, কিন্তু দ্বিমত করার সাহসও পায়নি সবার রোষের ভয়ে। জাহাজের খোলের মধ্যে থাকা ওই কালোকুচ্ছিৎ মানুষগুলোকে ওপরতলার মানুষেরা মনে মনে যতই ঘেন্না করুক, কিছুটা ভয়ও আবার পায়! জাহাজের সবচেয়ে জটিল দায়িত্ব যাদের, মানে এই বছরের জন্য সকল সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্ব যেই নেতাদের- তারা পড়ে গেল মহা চিন্তায়, ঘর বন্ধ করে কী সব মিটিং টিটিং করতে লাগল সারাদিন!
এইসব হ্যাপা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিল যখন সবাই, এক দুর্যোগের রাতে কথা নেই বার্তা নেই জাহাজ আক্রমণ করে বসল জলদস্যুরা। হঠাৎ করেই জাহাজের দায়িত্বে থাকা নেতাগোছের কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না, পরে জানা গেল সামনে বিপদ দেখেই ভাঁড়ার খালি করে ছোট একটা নৌকা নিয়ে তারা পালিয়েছে। সবার খাওয়া-পরার বরাদ্দ সমান থাকলেও জাহাজের ভাঁড়ারে এই মানুষগুলোর বিশেষ যাতায়াত যে ছিল তা অন্যরা তখনই প্রথম জানতে পারে। পুরো জাহাজে নেবার মত খুব বেশি জিনিস অবশিষ্ট ছিলনা, যা ছিল তা-ও ধুয়েমুছে নিয়ে গেল দস্যুদল। বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা উদ্দেশ্যহীনভাবে ভাসতে ভাসতে এসে নোঙর ফেলল এই বন্দরে।
ছোট থেকে বুড়ো, সকলেই সত্যিকার অর্থেই বড় কষ্ট পেল অতিথিদের এই দুর্দশার গল্প শুনে। কিন্তু তাদের কী-ই বা করার আছে সান্ত্বনা দেয়া ছাড়া? দুদিন পর যখন বিদেশিরা বিদায় নিল, তখনো তাদের উদ্ভ্রান্ত ভাব পুরোপুরি কাটেনি। চলে যাবার পর রাজ্যজুড়ে কতই না আলোচনা হল তাদের নিয়ে। বুড়োরা জিভ চুক চুক করে বলল, অল্প বয়সীদের বুদ্ধিতে চলতে গেলে এমনটাই হয়- আহারে বেচারারা! তরুণরা কিছুই বলল না, গোল হয়ে বসে মাটিতে হিজিবিজি দাগ টানতে টানতে কী ভাবতে লাগল তারাই জানে। খাজনার সময় এগিয়ে আসছে, নতুন রাজা নতুন কী-সব কর চাপিয়েছে। বিদেশিদের নিয়ে পড়ে থাকলে আমাদের রাজ্যের মানুষদের চলে না। কাজে ফিরতে হল সবাইকেই, কদিন পর বিদেশি বন্ধুদের স্মৃতি বেশ খানিকটা ঝাপসাও হয়ে এল সবার মনে।
শুধু অনেকদিন পর পর রাজ্যের ছোট্ট বন্দরে কোন জাহাজের ভোঁ-ও-ও শব্দ শোনা যায় যখন, একটি কিশোর ছুটে গিয়ে উঁকি দেয়, নতুন কোন জাহাজ এল কি?
********************************************
[গত কিছুদিন করোনায় ভুগে হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। আক্ষরিক অর্থেই শুয়ে থাকা ছাড়া কোন কাজ নেই, বই পড়লেও মাথায় যন্ত্রণা হত। শুয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে নানা গল্প মাথায় ঘোরাঘুরি করত, ভেবেছিলাম একটু সোজা হয়েই সব লিখতে বসব।সব লেখা হবে কিনা জানিনা, দ্রুতই সুস্থ হয়ে কাজে ফিরতে হবে। তার আগেই এই গল্পটা টুকে রাখলাম ভুলে যাবার আগেই। ]