Friday, November 22, 2024

হাসনাহেনার ঝাড়: পর্ব- রং, সুর আর ঘ্রাণ

রঙের সাথে ঘ্রাণ আর স্বাদের এসোসিয়েশন হয় কী করে এটার উত্তর অনেকদিন খুঁজেছি। বেগুনি রঙের সাথে তেতো একটা স্বাদ কেন পাই, কেনোই বা হলুদ রংটার সাথে একটা ঘাস ঘাস ঘ্রাণ মিশে থাকে এর কারণ বুঝিনি অনেকদিন। তারপর এক কটকটে রোদের দিন ঢাকার রাস্তার বিচ্ছিরি জ্যাম আর বাস কন্ডাক্টরের খিস্তি ছাপিয়ে চোখ কেড়ে নিলো একগোছা ঝলমলে হলুদ অলকানন্দা ফুল। একটা মলিন বাড়ির ততোধিক মলিন বারান্দায় একদম বেমানান হয়ে ফুটে আছে। দেখে মনে হচ্ছে খুব সুবেশী একদল মানুষ ভীষণ অস্বস্তিতে ফার্মগেট টু যাত্রাবাড়ী বাসের চলতা উঠে যাওয়া চিটচিটে সীটে বসে উসখুস করছে। 

তো সেই অলকানন্দা ফুল একধাক্কায় নিয়ে গেলো ছোটবেলায়, ময়মনসিংহের যে গেস্ট হাউজে আমরা থাকতাম তার দোতলার টেরেসে ছিল এই অলোকানন্দার বিশাল ঝাড়। এত সুন্দর ফুল কিন্তু তেমন সুঘ্রাণ নেই, কেমন ঘাস ঘাস ঘ্রাণ, খুব অবাক লাগত। এই ফুলের পাপড়ি গুটিয়ে খুব জোরে হাতের তেলোয় মারলে পটকা ফোটার মত শব্দ হয়, আম্মু শিখিয়েছিল এই খেলা। সরকারি অফিসের চৌহদ্দিতে, অতি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বড় হবার কারণে পটকা, তারাবাতির মত দোষণীয় দ্রব্য কোনোকালেই আমাদের নাগালে ছিল না, তাই অলকানন্দার এই পটকা ফোটার শব্দেই আমাদের খুব আনন্দ হতো। এই ফুলের পাশেই ছিল নীলচে বেগুনি রঙের, ঘণ্টা আকৃতির অতি সুদৃশ্য আরেক জাতের ফুলের ঝাড়, পরে জেনেছি এর নাম নীল পারুল। আম্মু আগেই সতর্ক করেছিল, এই ফুল নিয়ে খেললে ভালো করে হাত ধুয়ে ফেলতে; কিন্তু সে কি আর মনে থাকে? ফলস্বরূপ, অসাবধানে হাত গেলো মুখে, আর বিচ্ছিরি তেতো স্বাদ মনে হয় যেন নাকে মুখে ছড়িয়ে গেলো। এত সুন্দর ফুলের এই রকম স্বাদ, কী অবাক কান্ড!

ভাগ্যিস এটাই আমাদের একমাত্র খেলা ছিল না।

শিশু বয়সে খুব প্রচলিত যেসব খেলা, যেমন বউছি বা ডাংগুলি খেলার সাথে আমাদের তেমন পরিচয় ছিল না। দলে বলে খেলার সুযোগ শুধু স্কুলের টিফিন পিরিয়ডের অল্প সময়টুকু, বরফপানি বা ওপেন্টি বায়স্কোপের জন্যেও সেটা বড় অল্প সময়। বাসায় ফেরার পর আমরা বড় দুইবোনই পরস্পরের একমাত্র খেলার সঙ্গী, সবচে ছোটটার তখনও জন্ম হয়নি, আরেক বোন তখনও মাটির সাথে কথা বলে। এখন যেই সময়ের কথা বলছি সেটা অবশ্য স্কুলে ভর্তি হবারও আগের। ঐসময় যেহেতু অন্য সংগীসাথি নেই, দুইজন মিলে বিচিত্র সব খেলা উদ্ভাবন করাই ছিল আমাদের কাজ। অবশ্য ভুল বললাম, আমাদের খেলার একজন দুর্দান্ত সঙ্গী ছিল, আম্মু। ফেলনা কাপড় পেঁচিয়ে পুতুল বানানোর আইডিয়া দেয়া থেকে শুরু করে রান্নাবাটী খেলায় মেহমান হয়ে এসে রান্নার প্রশংসা করা, কোনোকিছুতেই তার আগ্রহের কমতি ছিল না।

অবশ্য খেলার চেয়েও বেশি আম্মুর আগ্রহ ছিল ক্রাফটিংয়ে। সেই সুবাদে আমাদের খেলায় দারুণ সব অনুষঙ্গ যোগ হতো। যেমন, রান্নাবাটি খেলা তো সব বাচ্চারাই খেলে, আমাদের ক্ষেত্রে এই খেলা ছিল improvised। আমাদের ছোট ছোট হাঁড়িপাতিলের সাথে ছোট্ট একটা ফ্রিজও ছিল! পুরোনো প্যাকিং বাক্সের শোলা কেটে কুটে আম্মু বানিয়ে দিয়েছিল এই ফ্রিজ, তাতে পাল্লা ছিল, শেলফ পর্যন্ত ছিল। আমরা খেলা শেষে সিরিয়াস মুখে 'left over' গুলো ফ্রিজে তুলে রাখতাম!
আর ছিল আমাদের টিভি। ম্যাচের বা সিগারেটের বাক্সের সামনের দিকে চৌকোনা করে কেটে বানানো হতো স্ক্রিন, ভেতরে হাতে আঁকা ছবি বায়স্কোপের মত সেট করে কাঠি দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখা যেতো।

আম্মুর থেকে ক্র্যাফটিংয়ের শখ আমাদের দুইবোনের মধ্যেই সংক্রমিত হয়েছিল। একবার খুব মাটির জিনিস বানানোর হিড়িক পড়ল আমাদের। অফিস ও আমাদের বাসার বাগান দেখাশোনার জন্য ছিলেন গণি কাকা, কুচকুচে কালো কষ্টিপাথরের মত রং, পেটা শরীর, আর মুখভর্তি হাসি নিয়ে আমাদের নানা আবদার মেটাতেন তিনি। আব্বুকে যেগুলো বলার সাহস নেই, সেসব শখ মেটানোর জন্য গণি কাকা, মোতালেব কাকা, আইনদ্দি কাকা ছিলেন এক পায়ে খাড়া। আমরা মাটির জিনিস বানালে ভেঙে ভেঙে পড়ে, তাই দেখে গণি কাকা অফিসের পুকুরের নিচ থেকে এনে দিলেন আঠালো এঁটেল মাটি। সেই মাটি দিয়ে বানানো হলো নৌকা, ঘর, টেপা পুতুল। বানানো শেষে একেকটা শিল্পকর্ম আম্মুকে দেখানো হতো, সেখানে সবসময়ই কিছু ফিডব্যাক পাওয়া যেতো। আম্মু কখনোই অকারণ প্রশংসায় ভাসিয়ে দিত না, কাজেই তার মতামত আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আস্তে আস্তে শিখলাম, মাটির সাথে খড় কুচি মিশিয়ে দিলে টেকসই হয় বেশি। 

মাটির জিনিস বানানোর থেকে সহজ ছিল কাগজের ক্র্যাফটিং; কাগজের ফুল, কিংবা ঈদের আগে বা নববর্ষের সময় আর্ট পেপার কেটে বানানো কার্ড। সরকারি বাসার বিশাল ড্রয়িংরুম ছিল আমাদের কাজের ওয়ার্কশপ, ব্যাকগ্রাউন্ডে হেমন্ত উদাত্ত কণ্ঠে গেয়ে চলতেন, "ধিতাং ধিতাং বোলে, কে মাদলে তান তোলে, কার আনন্দ উচ্ছ্বলে আকাশ ভরে জোছনায়..."। 

অঞ্জন তখনও তার পুরোনো গিটার বাজিয়ে আমাদের আকুল করেন নি; কবীর সুমন তখনো চ্যাটার্জি, গানওয়ালা নিয়ে হাজির হন নি আমাদের ড্রয়িংরুমে। কাজেই আমাদের শৈশব তখন পর্যন্ত হেমন্তের কণ্ঠে আর সলিল চৌধুরীর সুরেই বলতে গেলে বাঁধা ছিল, আর মাঝে মাঝে ছিল শ্যামল মিত্র, সাগর সেন, সুচিত্রা মিত্রদের যাওয়া আসা। 

বলাই বাহুল্য, শৈশবের এসকল সুর আম্মুর থেকেই পাওয়া।

রঙের সাথে ঘ্রাণের এসোসিয়েশনের কথায় ফিরে যাই। একবার খুব আয়োজন করে বাসা রং করা হলো, চুনকামের ঘ্রাণে বাতাস ভারি। সেই থেকে হলদে সাদা রংটা কিভাবে যেনো এই চুনকামের ঘ্রাণের মধ্যে আটকে গেলো। এখনও কোথাও এই রং দেখলেই নাকে এই ঘ্রাণ ধাক্কা দেয়। তবে ধবধবে সাদা রংটা সবসময় বেলি আর গন্ধরাজের জন্য বাঁধা, সাদা মানেই বর্ষাকাল, গন্ধরাজ বা বেলির পাঁপড়ির ওপর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। সাদা রঙের সাথে বর্ষার ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণটাই ছিল আজীবনের এসোসিয়েশন।

তবে সেটা দুবছর আগে সব ওলটপালট হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত।

সাদা ছিল বেলি আর গন্ধরাজের ঘ্রাণ। এখন সাদা রং মানে শুধুই আইসিইউ, হাসপাতাল, আর বিষণ্ন মৃত্যুর ঘ্রাণ।

আমাদের সব সুর, রং, ঘ্রাণ বুকে নিয়ে একটা মানুষ চলে গেছে। আজ তার জন্মদিন।

শুভ জন্মদিন আম্মু!

Tuesday, November 19, 2024

সময় আসুক, একদিন বুঝবা!

ক্লাস সেভেনে রেজাল্ট বেশ খারাপ হয়েছিল, আগের সব বছরের চেয়ে খারাপ। তখন একটা ভয়ানক চল ছিল। এসএসসি আর এইচএসসিতে স্ট্যান্ড করা, মেধাতালিকায় প্রথম দ্বিতীয় হওয়া কয়েকজনকে টিভিতে আনা হতো। চশমা পরা, বয়সের তুলনায় অস্বাভাবিক গম্ভীর সেইসব ছেলেমেয়েরা তাদের সাফল্যের পেছনের পরিশ্রমের গল্প শুনাত; কেউ পড়ালেখা করেছে দিনে সতের ঘণ্টা, কেউ উনিশ। আমাদের মতো মাঝারি মানের ছাত্রদের বাধ্যতামূলকভাবে সেই সব অনুষ্ঠান দেখতে হতো। উনিশ ঘণ্টা ক্লাসের বই পড়া? শুনেই দম আটকে আসত আমার; তাহলে গল্পের বই পড়ব কখন? আড্ডা মারব কখন? এইসব মুখ ফুটে বলা বিপজ্জনক, কাজেই চুপচাপ থাকতাম। এসব অনুষ্ঠান দেখেও আচরণের আশানুরূপ পরিবর্তন না দেখায় মুরুব্বিরা গম্ভীর মুখে বলত,

সময় আসুক, ঠিকই বুঝবা, তখন আফসোস করবা!”

সেভেনের সেই রেজাল্টের পর সবার মুখ থমথমে। পারিবারিক আলোচনায় অসংখ্য উপদেশ, এই রেজাল্ট নিয়ে জীবনে কী ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে তার রোমহর্ষক বর্ণনার পর সবশেষে সেই অমোঘ বাক্য “সময় আসুক, একদিন বুঝবা!”

মাঝারি রেজাল্ট করে স্কুল কলেজ পাশ করলাম, মেডিক্যাল বুয়েট না হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উৎরে গেলাম। সেভেনের সেই রেজাল্ট আমার নিজেরই আর মনে রইল না। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে রেজাল্টের লক্ষণীয় উন্নতি হওয়ায় কিছুদিন পর সেই আপ্তবাক্য পড়ালেখা ছেড়ে অন্যদিকে ঘুরে গেলো।

রান্নাবান্না কিছুই শেখ নাই? ঘরের কাজও তো পারো না। জীবন চলবে কেমনে? এখন তো বুঝতেস না; সময় আসুক, একদিন বুঝবা!”

সেই একদিনের আশঙ্কা বুকে নিয়েই পড়ালেখা শেষ করলাম। আঁকাআঁকি করি, উন্মাদে যাই, নিউ এইজে কার্টুন আঁকি। সবার মুখে হাসি ফুটিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করলাম। সামাজিক বিচারে এলিট শ্রেণিতে নাম লেখালাম, ভাবলাম এবার মুক্তি! কিন্তু না!

এখনো বিয়ে করো নাই? বয়স তো চলে যায়! আজকালকার মেয়েরা ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটতে ছুটতে সংসার ভুলে যায়। সময় আসুক, একদিন বুঝবা কতবড় ভুল করতেস!”

রাজশাহীতে একার সংসার। ক্লাসে মহা উৎসাহে ছাত্র পড়াই, নিজের ঘরে বসে কার্টুন আঁকি; সপ্তাহান্তে ঢাকায় এসে বাসায় সময় কাটাই, উন্মাদে গিয়ে আড্ডা দিই; নিরুদ্বেগ জীবন! এদিকে চারপাশ থেকে একটাই কথা, “একদিন বুঝবা!” চেনা, অচেনা, আধচেনা মানুষজন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়ে যাচ্ছে, সবারই দেখছি পরিচিত কোনো না কোনো ‘এলিজিবল ব্যাচেলর’ আছে।

এই যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে এমনটা নয়; বরং নিজের পছন্দেই একসময় বিয়ে করে ফেললাম, সামাজিক বিচারে সামান্য ‘বেশি বয়সে’ যদিও। ভাবলাম, এবার তো আর চিন্তা নাই, প্রপার সামাজিক জীবন!

কিন্তু না, ছয় মাস না যেতেই নতুন পেরেশানি, “বাচ্চা নেবে কবে?”

প্রথম প্রথম দুইজন এই প্রশ্ন হাসিমুখে এড়িয়ে যাই, তারপর থেকে যারা বলে তাদেরকেই এড়াতে শুরু করি; কিন্তু আলোচনা থামে না। বয়স বেড়ে যাচ্ছে, মেয়েদের বাচ্চা মানুষ করাই আসল কাজ, মা হওয়াটাই আসল ক্যারিয়ার, ইত্যাদি ইত্যাদি বহু বাক্যের পর আসে সেই অমোঘ বাক্য, “সময় আসুক, একদিন বুঝবা!”

এই বাক্য এক কান দিয়ে শুনতে শুনতে এতদিনে আরেক কান দিয়ে বের করাও শিখে গেছি। এদিকে সময় গড়ায়, আমরা আমাদের দুই শহরে পেতে রাখা ভ্রাম্যমান সংসারে অভ্যস্ত হয়ে উঠি। তবে কথায় আছে সুখে থাকলে মানুষ ভুতের কিল খায়; আমি খেলাম ব্রহ্মদত্যির কিল! পরিবার-পরিজন-শুভানুধ্যায়ী সবার হৃদয় ভেঙে দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্বাধীন পেশায় ফিরলাম। নিজের মতো কাজ বাছি, কাজ করি, ইনকাম যা হয় তাতে আমার ভালভাবেই চলে যায়। সময়ে অসময়ে নানা জনের আফসোস,

এমন চাকরি কেউ ছাড়ে? বয়স কম তো, তাই বুঝতেস না। সময় আসুক, একদিন বুঝবা!”

এদিকে বাচ্চা নেয়া বিষয়ক প্রশ্নবাণও থেমে নেই। এভাবেই বেশ কিছু বছর কাটে, একসময় আমরা সত্যি সত্যি পরিবারে নতুন সদস্য আনতে আগ্রহী হই। তার দেড় বছরের মাথায় আমাদের ঘর থেকে একজন অতিদুরন্ত কন্যাশিশুর গলা শুনতে পাওয়া যায়।

পড়ালেখা-ক্যারিয়ার-বিয়ে-বাচ্চা সব তো হলো, ভাবলাম আমাদের নিয়ে লোকের আফসোসের কাল তবে শেষ হল! দুইজন মহাসুখে বাচ্চা পালি, ঘরের-বাইরের কাজকর্ম করি; মোটামুটি নির্বিঘ্ন জীবন।

অনু, মানে আমাদের মেয়ের বয়স আট মাস হলো। সদ্য সলিড খাবার শুরু করেছে, বিভিন্ন খাবারের স্বাদের সাথে পরিচিত হচ্ছে, আমাদের খাবার টেবিলে ছোট ছোট থালাবাটির সংযোজন ঘটছে। সে যা খায়, তার চেয়ে বেশি মাখে, আমরা দুইজন সেই দৃশ্য মুগ্ধ হয়ে দেখি। যখন আমাদের অবাক করে অতিদ্রুত সে কিছু শিখে ফেলে, আমরা আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই। মেয়ের জন্মের পর আমাদের ফোন এবং টিভির ব্যবহার আগের চেয়েও কমে গেছে, বাচ্চার স্ক্রিনে আসক্তি যাতে না হয় তার শুরু হিসেবে নিজেদের আসক্তি কমানোর চেষ্টায় আছি দুইজনেই। সেদিন এক দাওয়াতে গেলাম, সেখানে বিভিন্ন বয়সী বাচ্চাকাচ্চা, এবং বিভিন্ন বয়সী বাবা-মা। বছর তিনেকের এক পিচ্চিকে খাওয়ানোর জন্য এক মা প্লেটে খাবার মেখে বসেছে। এদেশের খুব সাধারণ দৃশ্য, ভদ্রমহিলা নিজের স্মার্টফোনে কিছু একটা চালু করে পিচ্চির হাতে দিল; পিচ্চি সম্মোহিতের মত সেই জিনিস দেখতে দেখতে হাঁ করছে, আর তার মা সেখানে খাবার পুরে দিচ্ছে। আমাদের চেহারায় জাজমেন্টাল ভাব যাতে ফুটে না ওঠে সেজন্য আমরা অন্যদিকে তাকিয়ে খেয়ে নিচ্ছি। একসময় উনি নিজেই বলে ওঠেন,

ভাবী, বাচ্চাকে ফোন দেন না? খাওয়ান কীভাবে?”

ফোন দেই না আপা, এমনিতেই খায়।”

তাহলে কি টিভি দেখতে দেখতে খায়?”

না আপা, ও নিজের ইচ্ছাতেই খায়। আর খেতে না চাইলে জোর করে খাওয়াই না।”

ভদ্রমহিলা চোখ কপালে তুলে তাকালেন, উত্তর খুঁজছেন। অনুর দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন। তারপর হাসিমুখে তাকিয়ে বললেন,

ওহ! আপনার বাচ্চা তো ছোট! বড় হলে ঠিকই সামনে ফোন দেয়া লাগবে! না দিলে খাবেই না!”

আমরা একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করলাম, ফোন সামনে নিয়ে খাওয়ানোর অভ্যেস আমরা না করালে এই অভ্যেস নিজে নিজে কীভাবে হবে? ভদ্রমহিলা আমাদের প্রশ্নকে উড়িয়ে দিয়ে ছাড়লেন সেই ব্রহ্মাস্ত্র!

নিজেদের সময় আসুক, একদিন ঠিকই বুঝবেন!”

আপাতত আমরা সেই ‘একদিনের’ অপেক্ষায় আছি।

সম্ভবত বাকি জীবন এই অপেক্ষাতেই কাটবে।